বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক অস্থিরতার বছর
২০২৫ সালটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য মাঠের অর্জনের চেয়ে মাঠের বাইরের অস্থিরতার কারণেই বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিন ফরম্যাটেই পুরুষ, নারী এবং বয়সভিত্তিক দলগুলো প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তবে তাদের এই হতাশাজনক পারফরম্যান্স ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-এর অভ্যন্তরে চলমান প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা।
বিপিএল কেলেঙ্কারি ও বকেয়া পাওনা
বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ১১তম আসরে ব্যাপক ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে। অ্যান্টি-করাপশন ইউনিট (এসিইউ)-এর রেড ফ্ল্যাগ দেখানোর পর মিডিয়াতে খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিদের নাম উঠে আসে।
বিসিবি দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং নয় মাসব্যাপী তদন্ত শেষে ৯০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেয়, যা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। বোর্ড পরে আইসিসির সাবেক দুর্নীতি দমন প্রধান অ্যালেক্স মার্শালকে তাদের এসিইউ সংস্কারের জন্য নিয়োগ দেয়। তাকে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দেওয়া হয় এবং তার সুপারিশের ভিত্তিতে সন্দেহভাজনদের পরবর্তী বিপিএল আসর থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
এরই মধ্যে 'দুর্বার রাজশাহী' এবং 'চট্টগ্রাম কিংস' ফ্র্যাঞ্চাইজিদের বকেয়া পাওনা নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতা সামাল দিতে বোর্ড হিমশিম খায়, যা দেশি-বিদেশি মহলে লিগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। শেষ পর্যন্ত বিসিবি ১২তম আসর শুরুর লক্ষ্যে চারটি নতুনসহ মোট ছয়টি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নতুন করে চুক্তি প্রদান করে।
গঠনতন্ত্র সংশোধন বাধাগ্রস্ত এবং সভাপতির পতন
২০২৫ সালের বিসিবি নির্বাচনের আগে ফারুক আহমেদের নেতৃত্বাধীন বোর্ড গঠনতন্ত্র সংশোধনের চেষ্টা করে। এর লক্ষ্য ছিল ঢাকা ক্লাবগুলোর প্রভাব কমানো, যাদের হাতে ৭৬টি কাউন্সিলর ভোট এবং ২৫ জন পরিচালকের মধ্যে ১২ জনকে নির্বাচনের ক্ষমতা থাকে।
প্রস্তাবিত পরিবর্তনের খবর ফাঁস হতেই প্রতিবাদ শুরু হয় এবং ক্লাবগুলো বয়কটের ঘোষণা দেয়, যার ফলে ঘরোয়া লিগগুলো পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সংশোধনী প্রক্রিয়া বাতিল করতে হয়।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে মে মাসে, যখন আটজন পরিচালক ফারুকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করেন। এর ফলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) তার পরিচালক পদ বাতিল করে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার সভাপতিত্বের অবসান ঘটায়। সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শুরুতে দীর্ঘমেয়াদী কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই বললেও, বুলবুল পরে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ৬ অক্টোবরের এক বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে চার বছরের পূর্ণ মেয়াদে জয়ী হন। নির্বাচন প্রক্রিয়াটি কাউন্সিলর মনোনয়নে কারচুপি, মামলা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তাধীন ১৫টি ক্লাবের ভোটাধিকার বারবার স্থগিত ও পুনর্বহালের অভিযোগে জর্জরিত ছিল।
তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের প্রকাশ্য সংশ্লিষ্টতা সমালোচনা আরও বাড়িয়ে দেয়। তামিম ইকবালের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল নির্বাচন বয়কট করে। ভোটার উপস্থিতি ছিল কম, বেশ কয়েকজন পরিচালক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং বুলবুল পুনরায় সভাপতি হন—যেখানে ফারুক আহমেদ নাটকীয়ভাবে তার সহ-সভাপতি হিসেবে ফিরে আসেন।
বিসিবি বনাম ঢাকা ক্লাব
নির্বাচনের পর বিসিবি এবং ঢাকা ক্লাবগুলোর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। অধিকাংশ ক্লাব নির্বাচনের অনিয়মের অভিযোগে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বয়কট বা বয়কটের হুমকি দেয়। এই অচলাবস্থা শত শত ক্রিকেটারের জীবিকাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বর্তমানে চলমান ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ আটটি ক্লাব বর্জন করেছে এবং দ্বিতীয় বিভাগসহ অন্যান্য টুর্নামেন্টেও একই পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাহানারা আলমের বিস্ফোরক অভিযোগ
নভেম্বরে সাবেক নারী অধিনায়ক জাহানারা আলম বিসিবির বিরুদ্ধে একটি বিস্ফোরক অভিযোগ আনেন। তিনি সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার মঞ্জুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির প্রকাশ্য অভিযোগ করেন। বোর্ড শুরুতে এটি অস্বীকার করলেও পরে তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। দফায় দফায় সময় বাড়ানো হলেও তদন্তের কোনো সুরাহা হয়নি। এর মধ্যে আরও কয়েকজন নারী ক্রিকেটার ও অ্যাথলেট অন্যদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ নিয়ে সামনে এসেছেন।
হৃদয়ের শাস্তি
এপ্রিল মাসে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকতের প্রতি অসদাচরণের দায়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তাওহিদ হৃদয়কে নিষিদ্ধ করা হয়। এই ঘটনা খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে; ক্রিকেটাররা হৃদয়ের পাশে দাঁড়ান এবং আম্পায়ার পদত্যাগের হুমকি দেন। পরে হৃদয় পুনরায় শৃঙ্খলাভঙ্গ করলে বড় মেয়াদে নিষিদ্ধ হন, যার ফলে তিনি লিগের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে খেলতে পারেননি (যেটিতে আবাহনী লিমিটেড জয়ী হয়)।
শান্তর অধিনায়কত্ব নাটক
জুন মাসে শ্রীলঙ্কা সফরের ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে নাজমুল হোসেন শান্তকে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, যা ক্রিকেট অপারেশনস বিভাগের চরম সমন্বয়হীনতাকে প্রকাশ করে দেয়। এর জেরে শান্ত টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকেও পদত্যাগ করেন। তবে পরে বোর্ডের সাথে আলোচনার পর তিনি ২০২৫-২৭ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চক্রের জন্য পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শামীম ইস্যু: লিটন বনাম লিপু
স্কোয়াড নির্বাচন নিয়ে টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক লিটন দাসের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচকদের দূরত্ব তৈরি হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ থেকে অলরাউন্ডার শামীম হোসেনকে বাদ দেওয়া হয়। লিটন সংবাদমাধ্যমে জানান যে তিনি শামীমকে দলে চেয়েছিলেন এবং নির্বাচকদের তা জানিয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুকে জনসমক্ষে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হয়। পরে শামীমকে তৃতীয় টি-টোয়েন্টির স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তিনি মূল একাদশেও খেলেন।
সামগ্রিকভাবে, ২০২৫ সাল ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য মাঠের বাইরের অন্তহীন বিতর্কের বছর—যা অর্জনের চেয়ে অস্থিরতার বছর হিসেবেই বেশি চিহ্নিত হয়ে থাকবে।


Comments