কাণ্ডজ্ঞানহীন সেলিব্রেশন ও আমাদের খেলোয়াড়দের মানসিকতা

ছবি: ফিরোজ আহমেদ

ঢাকার রাত তখন গরম আর উত্তেজনায় থরথর করছে। আলো ঝলমলে গ্যালারিতে হাজারো কণ্ঠের গর্জন মিশে গেছে রাতের হালকা বাতাসে। স্কোরবোর্ড বলছে দুই গোলে পিছিয়ে বাংলাদেশ। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আশা এখনো বেঁচে। এমন এক মুহূর্তে প্রতিপক্ষ গোলরক্ষকের ব্যর্থতায় পেনাল্টি বক্সের ভেতরে বল এলো মোরসালিনের পায়ে। এক পলকে শট, বল গিয়ে জড়াল হংকংয়ের জালে। গ্যালারি এক ঝলকে বিস্ফোরিত হলো, যেন রাতের আকাশেও প্রতিধ্বনি হলো সেই গোলের শব্দ। কিন্তু ঠিক এরপর যা ঘটল, সেটাই বাংলাদেশের ফুটবলের আসল প্রতিচ্ছবি।

মোরসালিন দৌড়ে গিয়ে রোনালদোর সেই বিখ্যাত 'সিউ' সেলিব্রেশন করলেন, দুই হাত প্রসারিত, বুক উঁচু করে, চোখে উচ্ছ্বাসের আগুন। চারপাশে দর্শকের হাততালি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। অথচ সেই সময় স্কোরবোর্ড বলছে, বাংলাদেশ তখনো পিছিয়ে। জয় তো দূরের কথা, খেলা তখনও বাঁচানো যায় কি না সেটাই অনিশ্চিত। কানাডা প্রবাসী ফুটবলার শামিত সোম ছুটে গিয়ে বল তুলে আনেন জাল থেকে, চিৎকার করে বলছেন, 'দ্রুত, সময় নষ্ট কোরো না!' কিন্তু তখন মোরসালিন গোলের আনন্দে ডুবে আছেন, আর শামিতরা ভাবছেন কীভাবে দলটাকে ম্যাচে ফেরানো যায়।

এবার হংকংয়ের কাই তাক স্টেডিয়ামে ফিরতি ম্যাচ। বাংলাদেশের জন্য ম্যাচটা জীবন-মৃত্যুর সমান। জয় ছাড়া বিকল্প নেই। স্কোরলাইন তখনও প্রতিকূল। এক গোলে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এবার ফাহামেদুল ইসলামের হেড থেকে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে এড়িয়ে রাকিব হোসেন উড়ন্ত পাখির মতো ছোবল মেরে যেন আলতো শটে বল পাঠিয়ে দিলেন প্রতিপক্ষের জালে। সমতায় ফিরল বাংলাদেশ। কিন্তু কাজ তখনও শেষ হয়নি। কারণ বাংলাদেশকে তো জিততেই হবে। 

কিন্তু গোলের পর যা ঘটল, ঠিক আগের ম্যাচে যেমনটা করেছিলেন মোরসালিন। এবার রাকিব ছুটে গিয়ে স্টেডিয়ামের পাশের ইলেকট্রিক বোর্ডে উঠে বসে পড়লেন। মুখে উল্লাস, চোখে তৃপ্তি। আয়েশি ঢঙ্গে বসে রইলেন। হয়তো ভাবলেন, এই মুহূর্তে তিনিই নায়ক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ম্যাচ শেষ হওয়ার পথে, জয় তখনও দূরের বাতিঘর। কিন্তু হামজা ঠিকই বুঝলেন সময়ের গুরুত্ব। সেলিব্রেশনে যোগ না দিয়ে জাল থেকে বল কুঁড়িয়ে দৌড়ে মাঝমাঠে গিয়ে নির্ধারিত স্থানে রাখেন।

এই দুই বিপরীত ছবি আসলে আমাদের ক্রীড়াজগতের মানসিকতার প্রতিফলন। আমাদের খেলোয়াড়রা খুব অল্পতেই তুষ্ট। একটুখানি আলো পেলেই যেন নিজেকে সূর্য ভেবে বসেন। নিজের নামের পাশে একটি গোল, একটি হাফসেঞ্চুরি, বা একটি উইকেট, তাতেই যেন বিশ্ব জয় হয়ে যায়। দলের জয়-পরাজয়, ম্যাচের প্রেক্ষাপট এসব যেন গৌণ হয়ে পড়ে। আমরা ভুলে যাই, দলীয় খেলা মানে একসাথে লড়াই। একজনের উল্লাস যদি দলের সময় নষ্ট করে, তবে সেটা গৌরব নয় একটি ব্যর্থতা।

অন্যদিকে, কানাডা প্রবাসী শামিত সোম কিংবা ইউরোপ-ফেরত হামজারা জন্মেছেন ভিন্ন সংস্কৃতিতে। সেখানে জয় মানে শুধু স্কোরবোর্ডের জয় নয়, বরং মানসিকতার জয়। তারা জানেন, এখন সেলিব্রেশনের সময় নয়, কাজ তো সবে মাত্র শুরু। দল জিতলে তবেই উদযাপন। এমন অপ্রয়োজনীয় উদযাপন কেবল সময় নষ্টই নয়, মনোযোগও নষ্ট করে দেয় অনেক ক্ষেত্রে। যেমনটা হয়েছে হংকংয়ের বিপক্ষে ঘরের মাঠে। ৩-১ থেকে যোগ করা সময়ে ৩-৩ করেও মুহূর্তের মনোযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে হারতে হয় বাংলাদেশকে। 

আসলে এই পার্থক্যটাই বাংলাদেশি ও প্রবাসী ফুটবলারদের মনোজগতের সীমারেখা টেনে দেয়। আমাদের স্থানীয় খেলোয়াড়রা রোনালদোর মতো সেলিব্রেশন করতে চান, কিন্তু রোনালদোর মতো পরিশ্রম, আত্মনিয়ন্ত্রণ বা দলের প্রতি দায়বদ্ধতা শেখেন না। রোনালদো শত শত ম্যাচে গোল করার পরও প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করেন, নিজেকে আরও উন্নত করেন। তিনি জানেন, তার সেলিব্রেশন মানে অর্জনের প্রতীক, আত্মতুষ্টির নয়। আর আমাদের খেলোয়াড়রা সেই সেলিব্রেশন নকল করেন, কিন্তু মূল দর্শনটা ভুলে যান।

শুধু ফুটবলেই নয়, দেশের আরেক বৃহত্তর খেলা ক্রিকেটেও এই মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি ঘর করেছে অহরহ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে যখন মুশফিকুর রহিমের সেই বাউন্ডারি মেরে যে সেলিব্রেশন যা আরও অনলাইনে ট্রল আর মিম হয়ে ঘুরতে থাকে। কিন্তু মুশফিকরা বদলাননি। 

সেলিব্রেশন হতে পারে অনুপ্রেরণার প্রকাশ, কিন্তু যখন তা দায়িত্ববোধকে ছাপিয়ে যায়, তখন সেটি হয়ে ওঠে হাস্যকর। কারণ খেলোয়াড়ের আসল পরিচয় তার শরীরী ভঙ্গিতে নয়, তার প্রতিশ্রুতিতে। সেই রোনালদোর উদযাপন করেছেন, সেই রোনালদো কি কখনো নিজে দল পিছিয়ে থাকা অবস্থায় এমন উদযাপন করেছেন? উত্তরটা সবার জানা। তারা অপ্রয়োজনে উদযাপন করেন না। কিন্তু মোরসালিন বা রাকিবরা যেন সেখানে নিজেদের গল্প লিখতে চান -দলের নয়, নিজের।

এটাই বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আমরা এখনো বুঝতে পারিনি -গোল মানে শুধু গোল নয়, সেটি এক দায়িত্ব। গোল মানে ম্যাচে ফেরার সুযোগ, দলকে জেতানোর পথ। গোল মানে আত্মত্যাগের মুহূর্ত, যেখানে আনন্দ নয়, আরও বড় লড়াইয়ের আহ্বান থাকে। একদিন হয়তো আমরা বুঝব ফুটবল শুধু পায়ের খেলা নয়, এটি মস্তিষ্কেরও খেলা। যেদিন আমাদের খেলোয়াড়রা সেলিব্রেশনের আগে স্কোরবোর্ডের দিকে তাকাবে, সেদিনই বাংলাদেশ ফুটবল সত্যিকার অর্থে জিততে শুরু করবে।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s body being taken to Manik Mia Avenue for janaza

Janaza will be held at Manik Mia Avenue at 2pm

2h ago

Farewell

10h ago