প্রাথমিক স্কুলে ঝরে পড়ার হার ১৪ বছর পর আবার বেড়েছে

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার টানা ১৪ বছর কমতে থাকার পর গত বছর আবার বেড়েছে। সরকারি এক প্রতিবেদনে উঠে আসা এ তথ্যকে শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) গত মাসের শেষের দিকে প্রকাশিত 'বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিসংখ্যান (এপিএসএস) ২০২৪' অনুসারে ২০২৩ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুদ্রাস্ফীতিজনিত আর্থিক চাপ এবং অল্প বয়সে শ্রমবাজারে প্রবেশসহ বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে। এর ফলে অনেক পরিবার আর্থিক সংকটের কারণে সন্তানদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে অল্প বয়সেই শ্রমবাজারে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়, ছেলেদের ঝরে পড়ার হার মেয়েদের তুলনায় বেশি। ২০২৩ সালে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ছিল ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ০২ শতাংশে। অন্যদিকে, মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেড়ে ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

দেশে বর্তমানে ১ লাখ ১৮ হাজার ৬০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি শিশু পড়াশোনা করছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা যখন ওপরের শ্রেণিতে ওঠে তখন ঝরে পড়ার হার বেড়ে যায়। এতে বোঝা যায় যে প্রাথমিক শিক্ষার ধাপে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে শিক্ষার্থীরা।

শ্রেণিভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি বেশি হলেও ঝরে পড়ার হার কম। তবে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে এই প্রবণতা বাড়তে শুরু করে এবং চতুর্থ শ্রেণিতে এসে ঝরে পড়ার হার সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছায়।

'এসব ক্ষেত্রেই বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি,' বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

২০১০ সালের পর থেকে প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার কমাতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। সে সময় প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৪ জন প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারত না। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, উপবৃত্তির আওতা বৃদ্ধি এবং মধ্যাহ্নভোজের মতো বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপের ফলে বছরের পর বছর ধরে ঝরে পড়ার হার ধীরে ধীরে কমে আসে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে ঝরে পড়ার হার যেখানে ছিল ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০২০ সালে তা নেমে আসে ১৭ দশমিক ০২ শতাংশে। পরে ২০২৩ সালে আরও কমে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশে।

হঠাৎ বৃদ্ধির কারণ

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে  শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির যে প্রকৃত মূল্য তা কমে গেছে। ফলে অনেক পরিবার টিকে থাকার সন্তানের শিক্ষার চেয়ে জীবিকা নির্বাহকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।

পারিবারিক সংকট এবং জলবায়ুজনিত দুর্ভোগ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, ছেলেরা ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে বেশি, কারণ তারা অল্প বয়সেই শ্রমবাজারে প্রবেশ করে বা শিক্ষানবিশ কাজে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, শিক্ষার্থী ধরে রাখার এই উল্টোদিকের প্রবণতা বাংলাদেশের সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিতকরণ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ঝরে পড়া রোধ করতে বিশেষজ্ঞরা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপবৃত্তি চালু করার এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন।

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'সরকার সম্প্রতি উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ালেও, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তা তাল মেলাতে পারেনি।'

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, খাতা, কলম ও পেন্সিলের মতো শিক্ষা উপকরণের দামও বেড়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, 'এমন পরিস্থিতিতে পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের স্কুলে রাখতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। অনেকে মেয়েদেরকে ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়, আর ছেলেদেরকে উপার্জনের কাজে পাঠায়।'

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, উপবৃত্তি বাড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে আরও বেশি বিনিয়োগের আহ্বান জরুরি।

তিনি বলেন, 'সরকারকে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ধরে রাখা এবং তাদের শিক্ষার মান উন্নয়ন—উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের উপায় খুঁজতে হবে।'

ডিপিই মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান জানান, ঝরে পড়া রোধে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো ২০২২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম আবার চালু করা। আগামী মাস থেকে ১৬৫টি দরিদ্র উপজেলার প্রায় ২৩ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুনরায় এই কর্মসূচি শুরু হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে পাঁচ দিন বিস্কুট, ডিম, দুধ, বনরুটি এবং কলার তালিকা থেকে দুটি করে খাবার দেওয়া হবে।

তিনি আশা করেন, 'এটি প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে, স্কুলে উপস্থিতি বাড়াতে এবং ঝরে পড়ার হার কমাতে সাহায্য করবে।'

উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে শামসুজ্জামান বলেন, এই মুহূর্তে তাদের এমন কোনো পরিকল্পনা নেই, কারণ এর জন্য বড় বাজেট প্রয়োজন। তবে তিনি জানান, প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত ৮২ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থীর বৃত্তি বাড়ানো হতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English
Largest Islamic bank in the making

Largest Islamic bank in the making

The five banks slated for consolidation are First Security Islami Bank, Union Bank, Global Islami Bank, Social Islami Bank and Exim Bank.

11h ago