২৬ বছর পর নিজেদের ‘জলা’ বুঝে পেলেন জেলেরা

২ যুগেরও বেশি সময় পর কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এই চাকিরপশার নদীর ওপর আবার অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো স্থানীয় মৎস্যজীবীদের। ছবি: স্টার

১৯৯৬ সালের আগে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা চাকিরপশার নদী ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করতো অন্তত ৪০০ মৎস্যজীবী পরিবার। কিন্তু সরকারের জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি লঙ্ঘন করে ওই বছরই নদীর একটি অংশ ইজারা দেওয়ায় তাদের জীবন-জীবিকার ওপর খড়গ নেমে আসে।

শেষ পর্যন্ত মৎস্যজীবী ও নদীপাড়ের বাসিন্দাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তদন্ত ও সুপারিশ অনুসারে জেলা প্রশাসন নদীটির ইজারা বাতিল করে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরে তাসনিম। 

চলছে জাল মেরামতের কাজ। ছবি: স্টার

এই ঘোষণায় স্বস্তি এসেছে এখানকার ৪২০টি মৎসজীবী পরিবার ও নদীপাড়ের হাজারো মানুষের মনে।

খাস জলাশয় এবং জলমহাল ইজারা দেওয়ার জন্য 'সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি-২০০৯' বিদ্যমান আছে। এই নীতিমালায় উল্লেখ আছে, 'জাল যার জলা তার'। এই নীতিমালার ২ নম্বর ধারার 'খ' অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কোনো সমিতিতে যদি এমন কোনো সদস্য থাকেন যিনি প্রকৃত মত্স্যজীবী নহেন তবে সে সমিতি কোনো সরকারি জলমহাল বন্দোবস্ত পাওয়ার যোগ্য হবে না।'

এই ধারারই 'ক' অনুচ্ছেদে প্রকৃত মত্স্যজীবীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, 'যিনি প্রাকৃতিক উৎস হতে মাছ শিকার এবং বিক্রয় করেই প্রধানত জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি প্রকৃত মত্স্যজীবী বলে গণ্য হবেন।'

কিন্তু এই নীতিমালা উপেক্ষা করে চাকিরপশা ইজারা দেওয়ার পর নদী রক্ষায় রাজারহাটে গড়ে উঠে 'চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি'। মৎস্যজীবি ও নদীপাড়ের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামেন এ কমিটির সদস্যরা।

রাজারহাট উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৪০ সালের রেকর্ড অনুসারে চাকিরপশার নদীর মোট জায়গা ছিল ৩০৬ একর। কালের পরিক্রমায় নদীতে চর পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় দখলদাররা নদীর বিভিন্ন অংশে পাড় বেঁধে পুকুর, রাস্তা, ফসলি জমি বানিয়ে দখল করায় বর্তমানে নদীর মোট জায়গা দাঁড়িয়েছে ১৪১ একরে।

ইজারা বাতিলের ঘোষণায় স্বস্তি এসেছে স্থানীয় জেলে পরিবারগুলোতে। চলছে জাল মেরামত ও মাছ ধরার প্রস্তুতি। ছবি: স্টার

কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদনসহ প্রস্তাবনা জমা দেয় জেলা প্রশাসনের কাছে। প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো চাকিরপশার নদীর ইজারা বাতিল ও এটিকে মুক্ত জলাশয় হিসেবে রাখা। তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মাহমুদুল হাসান।

চাকিরপশার ইজারা বাতিলের ঘোষণায় স্বস্তি প্রকাশ করেন সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তার আশাবাদ, এবার নদীর জায়গা গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পাশাপাশি প্রশাসন উজানে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য নদী খননের কাজে হাত দেবে।

তার ভাষ্য, 'চাকিরপশার বেঁচে থাকলে এ অঞ্চলের জীব-বৈচিত্র্য বেঁচে থাকবে। জীবন-জীবিকা সমুন্নত থাকবে জেলেদের।'

কথা হয় মৎস্যজীবি হরেন্দ্র নাথ দাসের (৭৮) সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ইজারা দেওয়ার পর এই নদীতে আমাদের কোনো অধিকার ছিল না। অথচ এখানে মাছ ধরেই আমাদের জীবন চলত।'

এই নদীর ওপর সরাসরি নির্ভরশীল আরেক মৎস্যজীবি ব্রজেন্দ্র নাথ দাস (৮০) জানান, ইজারা দেওয়ার পর জেলে সম্প্রদায়ের অনেকেই কর্ম সংকটের পড়ে যান। পেশা বদলে বাধ্য হন কেউ কেউ।

শুকাতে দেওয়া জাল। ছবি: স্টার

এখন আবার তারা এই নদীতে ইচ্ছামতো মাছ ধরতে পারবেন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, 'চাকিরপশার আমাদের বেঁচে থাকার উৎস। নদীটি যেন আর কখনোই ইজারা দেওয়া না হয়।'

চাকিরপশার মৎস্যজীবি সমিতির সভাপতি যোগেন চন্দ্র জানান, নদীটিতে এখনো এ অঞ্চলের দেশি মাছের ভান্ডার। সারাবছরই এখানে মাছ পাওয়া যায়।

চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফের ভাষ্য, 'আইন লঙ্ঘন করে নদীটি মৎসজীবী নন এমন লোকদের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছিল। এটা বাতিল করায় আমাদের একটি দাবি পূরণ হয়েছে। এখন অন্য দাবিগুলো পূরণ হলে চাকিরপশার নদী আবার নতুন জীবন পাবে।'

কুড়িগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কালিপদ রায় বলেন, 'মৎস্যজীবীরা প্রান্তিক মানুষ। এসব প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা সমুন্নত রাখতে নদীটি সবসময়ই উন্মুক্ত রাখতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

6h ago