বর্ষসেরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান

ওয়ালটনের উত্থানে ‘পরিবর্তনের হাওয়া’

এস এম শামসুল আলম। ছবি: সংগৃহীত

নব্বই দশকের শিশুরা—যারা আজ অনেক বড়—নিশ্চই মনে করতে পারবেন, প্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখতে হলে দৌড়াতে হতো প্রতিবেশীর বাড়িতে। কারণ, অধিকাংশ বাড়িতেই টেলিভিশন ছিল না। ফ্রিজও তখন বেশ বিরল জিনিস।

আজকের দিনে পরিস্থিতি প্রায় সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এখন অধিকাংশ বাড়িতে টিভি ও ফ্রিজ রয়েছে।

নিঃসন্দেহে দেশে উৎপাদিত পণ্যের কারণেই পরিস্থিতির এমন আমূল পরিবর্তন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য সাশ্রয়ীমূল্যের হওয়ায়, পাশাপাশি আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ এসব পণ্য কিনতে পারছেন।

বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক পণ্য ও গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ওয়ালটন।

এ বছরের বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ডে 'বর্ষসেরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান'র পুরস্কার পেয়েছেন ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে প্রতি বছর ডিএইচএল এক্সপ্রেস বাংলাদেশ ও দ্য ডেইলি স্টার যৌথভাবে এ পুরস্কার আয়োজন করে। এটি ছিল এই পুরস্কারের ২৩তম আয়োজন।

একান্ত সাক্ষাৎকারে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির চেয়ারম্যান এস এম শামসুল আলম তুলে ধরেন তার প্রতিষ্ঠানের গল্প।

এস এম শামসুল আলম বলেন, 'আমরা যখন দেশে এই পণ্যগুলো উৎপাদন শুরু করি, তখন অনেকেই এগুলো কেনার কথা চিন্তাই করতো না।'

এমনকি দেশে ফ্রিজের ফ্যাক্টরি ডিজাইন করার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আছে এমন প্রকৌশলী খুঁজে পেতেও কষ্ট হয়েছে কোম্পানিটির।

শামসুল আলম ও তার চার ভাইকে তাদের পিতা সবসময় দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গলে জন্য কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে ২০০০ সালে তারা লক্ষ্য নির্ধারণ করেন, এমন পণ্য দেশেই উৎপাদন করবেন, যা দেশে উৎপাদিত হয় না এবং প্রায় সম্পূর্ণরূপে আমদানি নির্ভর।

শামসুল আলম বলেন, 'বাবা আমাদেরকে এমন পণ্য উৎপাদনের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, যাতে দেশ উপকৃত হয় এবং প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।'

পরবর্তীতে ওয়ালটন প্রায় ৫০০ প্রকৌশলী নিয়োগ করে এবং আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে এসব পণ্য উৎপাদনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে।

২০০৮ সালে তাদের সেই স্বপ্ন সত্যি হয়, যখন কোম্পানিটি ইলেকট্রনিক পণ্য ও গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি উৎপাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তারা বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করতে শুরু করে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে থাকে।

ওয়ালটন তার ব্র্যান্ডের অধীনে বিভিন্ন দেশে পণ্য বিক্রি করছে, যা দেশের ও কোম্পানিটির জন্য বড় অর্জন।

ওয়ালটনের গল্প বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় করপোরেট যাত্রার গল্পগুলোর একটি।

ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি উৎপাদনের অতি সাধারণ একটি কোম্পানি থেকে সারাদেশে পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে ওয়ালটন। গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে।

দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক পণ্য এবং গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করে সত্যিকার অর্থেই 'পরিবর্তনের হাওয়া' এনে দিয়েছে ওয়ালটন। একটি আমদানিভিত্তিক শিল্পকে রপ্তানির ধাবিত করতেও সফল হয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের উৎপাদন খাত দীর্ঘদিন ধরে পোশাক শিল্পনির্ভর ছিল। একটি দেশীয় ইলেকট্রনিক ব্র্যান্ড আন্তর্জাতিক জায়ান্টদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে, সেটা কেউ ধারণাও করতে পারেনি। কিন্তু, ওয়ালটন সেটাই করে দেখিয়েছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ওয়ালটনের মোট রপ্তানি আয় ৪৫ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এই আয় ছিল ২৭ কোটি টাকা।

বিশাল বিনিয়োগ, সার্বিক সমন্বয় ও সাশ্রয়ী মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে নজর রাখায় ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে তারা পুরো বদলে দিয়েছে।

ওয়ালটনের ফ্রিজ, টেলিভিশন ও পরে স্মার্টফোন রয়েছে এ দেশের লাখো বাড়িতে। আমদানিকৃত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তারা বদলে দিয়েছে ভোক্তাদের আচরণ।

সম্প্রতি, লিফট উৎপাদন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এটিও দেশের অন্যতম আমদানিভিত্তিক পণ্য।

২০০০-এর দশকের শেষের দিকে ইলেকট্রনিক পণ্য এবং গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি আমদানিকৃত ব্র্যান্ডের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল ছিল।

শামসুল আলম বলেন, স্থানীয় উৎপাদন, খরচ কমানো ও মান বজায় রেখে ওয়ালটন বাজারের এই শূন্যস্থান পূরণ করেছে এবং মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীর কাছে নির্ভরযোগ্য পণ্য পৌঁছে দিয়েছে।

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও সংযোজনকৃত টেলিভিশন এখন দেশের টেলিভিশন বাজারের প্রায় ৯০ শতাংশ দখলে রেখেছে। অথচ, এক দশক আগেও বাংলাদেশে এই বাজার পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল।

শিল্পের অভ্যন্তরীণ সূত্র অনুযায়ী, সরকার ২০১০-১১ অর্থবছরে ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদক ও সংযোজনকারীদের জন্য আমদানি শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়, যাতে এই খাতের প্রবৃদ্ধি সহজ হয় ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়।

শহর ও গ্রামে বিদ্যুতের সহজলভ্যতা ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে শুল্ক কমানোর এই সুযোগ কাজে এসেছে এবং এই বাজারের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।

এখন দেশে এই বাজারের আকার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার, যেখানে প্রতি বছর গড়ে স্থানীয় চাহিদা ১০ লাখ ইউনিটেরও বেশি।

শামসুল আলম বলেন, তাদের পণ্য সাশ্রয়ী হওয়ার প্রধান কারণ হলো এগুলো দেশেই উৎপাদিত হয় এবং এখানে শ্রম খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।

অন্যদিকে, যদি তারা তৈরি পণ্য পণ্য আমদানি করতো, তাহলে পরিবহন খরচের জন্যও বিশাল অর্থ প্রয়োজন হতো।

এখন তারা দেশেই পণ্যটি উৎপাদন ও সংযোজন করছেন এবং কেবল কাঁচামাল আমদানি করছেন। ফলে পণ্যের মোট খরচ আমদানিকৃত পণ্যের চেয়ে কম হচ্ছে।

কিন্তু ওয়ালটন কি সত্যিই মানুষের গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি সম্পর্কে ধারণা বদলে দিতে পেরেছে?

মূলত, এই খাতে নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। দেশের মানুষ এখন গৃহস্থালি যন্ত্রপাতিকে বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে না দেখে বরং প্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে দেখছে।

শামসুল আলম জানান, এক সময় এসব পণ্য সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর ছিল। এখন স্থানীয় কোম্পানিগুলোই বাজারের প্রায় ৯০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে।

ওয়ালটনই প্রতি বছর স্থানীয় চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পূরণ করছে। এ ছাড়া, স্থানীয় এই জায়ান্ট এখন প্রায় ৫০টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে।

অন্যদিকে, তাদের এই সাফল্য আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে যে, বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো কেবল পোশাক উৎপাদক হিসেবে নয়, বৈশ্বিক নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনেই প্রতিযোগিতা করতে পারে।

এর প্রত্যক্ষ প্রভাবও ফেলেছে। নতুন নতুন বহু প্রতিষ্ঠান এখন ওয়ালটনকে অনুসরণ করে, যা এই শিল্পের বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে। প্রথমবারের মতো 'মেড ইন বাংলাদেশ' ইলেকট্রনিক্স একটি বড় প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওয়ালটন যে পরিবর্তন এনেছে তা অবিস্মরণীয়। গ্রাম ও শহরে তাদের পণ্য আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ওয়ালটনের পণ্যের দাম সাশ্রয়ী হওয়ায় প্রায় সব বাড়িতে ফ্রিজ ও টিভি পৌঁছে গেছে।

ওয়ালটন হয়তো অর্থনীতির ধারা পুরোপুরি বদলে দিতে পারেনি, কিন্তু নিশ্চিতভাবে এটি বাংলাদেশিদের নিজস্ব সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করে দিয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে মানুষের মানসিকতায়। এক সময় মানুষ প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পে স্থানীয় কোম্পানিতে আস্থা রাখতে পারতো না। তবে এখন মানুষ ইলেকট্রনিক ও গৃহস্থালি পণ্য নির্বাচনের সময় স্থানীয় কোম্পানিতেই আস্থা রাখে।

ওয়ালটনের উত্থান দেখিয়েছে, যে দেশে আর্থিক অস্থিরতা ও শাসন ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানেও একটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কোম্পানি তার সাফল্যের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।

চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে শামসুল আলম বলেন, এই শিল্পকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া জরুরি।

এই ধরনের শিল্পের জন্য দক্ষ জনবল পাওয়া বিশেষভাবে কঠিন। এ ছাড়া, যখন কোম্পানি নতুন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলে, তখন কিছু কর্মী দেশ ছেড়ে চলে যায়। 'এটি খুব কষ্টের,' বলেন তিনি।

শামসুল আলম বলেন, 'একজন কর্মী প্রথম দুই বছর অভিজ্ঞতার অভাবে খুব বেশি অবদান রাখতে পারে না। যখন তাদের প্রশিক্ষণ নেওয়া শেষ হয় এবং কারখানায় অবদান রাখতে সক্ষম হয়, তখন চলে যায় বিদেশে। এটা বেশ ব্যয়বহুল ও কষ্টদায়ক।'

তিনি আরও বলেন, ব্যবসার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, কমপ্রেসর ও লিফট উৎপাদন।

শামসুল আলম বলেন, এটি তাদের কিছু সুবিধা দিয়েছে। যেমন: উৎপাদন খরচ কম রাখা। এর কারণেই তারা বাজার দখল করতে পেরেছে।

ওয়ালটনের পণ্যের মান বিষয়ে তিনি দাবি করেন, এখন আমদানিকৃত পণ্যের চেয়ে তাদের পণ্যের মান ভালো।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ওয়ালটন এমনকি পণ্যের স্ক্রুগুলোও উৎপাদন করছে। কারণ, এখানে আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ সীমিত। বিদেশি কোম্পানি তাদের বেশিরভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আউটসোর্স করে।

ওয়ালটন গবেষণা ও উন্নয়নে মনোযোগ দিচ্ছে এবং কোম্পানিতে ইতোমধ্যেই এক হাজারের বেশি প্রকৌশলী রয়েছে।

শামসুল আলম বলেন, 'গবেষণা ও উন্নয়ন ছাড়া আমাদের মতো একটি কোম্পানি এত দ্রুত এগোতে পারে না।'

সাম্প্রতিক ব্যবসার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ওয়ালটনের ঋণ পোর্টফোলিও তুলনামূলকভাবে ছোট। তাই ব্যাংকিংখাতে ঋণের সুদ বৃদ্ধির তেমন প্রভাব পড়েনি।

তবে, স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক দরপতন ও গত বছর শিল্পখাতটি কিছু ক্ষতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানান শামসুল আলম।

কোম্পানির আর্থিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ওয়ালটনের বিক্রি ৭ শতাংশ বেড়েছে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। একই সময়ে তাদের মুনাফা ৮ শতাংশ কমে ৬৯৬ কোটি হয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সময়ে বেশিরভাগ তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফা কমেছে।

শামসুল আলম সরকারকে এই শিল্পের জন্য নীতি সমর্থন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, সামগ্রিক পরিবেশ ব্যবসার জন্য অনুকূল হতে হবে, বন্দর ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, স্থিতিশীল বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে অন্যান্য সুযোগ প্রদান করতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Shibli Rubayat, Reaz Islam banned for life in market over scam

In 2022, asset management firm LR Global invested Tk 23.6 crore to acquire a 51 percent stake in Padma Printers, a delisted company, from six mutual funds it manages

1h ago