ঋণের ফাঁদে স্বপ্ন আর বাস্তবতায় বিস্তর ফারাক

ছবি: মোহাম্মদ জামিল খান

দালালের সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা চুক্তিতে এক বছর আগে মালয়েশিয়ায় যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরিফুল ইসলাম। প্রথম দুই মাস তাকে বেকার বসে থাকতে হয়েছিল। দুই মাস পর একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় কাজ পান আরিফুল। কাজটা পছন্দ না হলেও ৪২ বছর বয়সী আরিফুলকে কাজটি করতে হলো। কারণ দুমাস পেরিয়ে গেলেও তিনি তখনো কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি।

বর্তমানে ওভারটাইম সহ সবমিলিয়ে ৫৭ হাজার টাকার মতো আয় করেন আরিফুল। এর মধ্যে প্রতি মাসে ৩৪ হাজার টাকা তিনি দেশে পাঠান। তবে এখনো পর্যন্ত তিনি ঋণের টাকা পরিশোধের সুযোগই পাননি।

কুয়ালালামপুরে আরিফুল অন্য প্রবাসীদের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকেন। এরই মধ্যে তার কাজের পারমিট ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে তার পারমিট নবায়নের জন্য নতুন করে ৯২ হাজার টাকা লাগবে।

আরিফুল বলেন, 'দেশে থাকতে দালালেরা চাকরির কত রকমের প্রলোভন দেখায়। কিন্তু এখানে এলে বোঝা যায় বাস্তবতা কতটা কঠিন।'

এটি কেবল আরিফুলের একার প্রবাসজীবনের গল্প নয়। একই অভিজ্ঞতা মালয়েশিয়া প্রবাসী হাজারো বাংলাদেশির। প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মালয়েশিয়ায় আসেন। এসেই তারা দেখেন দীর্ঘ কর্মঘণ্টার পরেও কম মজুরির বেতনের পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর বাসায় তাদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে।

তবে সবাইকেই যে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়, এমনটি নয়। কেউ কেউ ভালো চাকরি পেয়ে নিয়মিতভাবে দেশে টাকা পাঠান। ফলে অভিবাসনের সম্ভাবনা এবং ঝুঁকি দুটোই দেখা যায়।

ছবি: সৈয়দ কামরুল হোসেন ও শাকিল চৌধুরী

দালাল আর দেনার ফাঁদ

বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশের প্রান্তিক গ্রামগুলো থেকে লাখ লাখ প্রবাসী ভালো আয়ের আশায় মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছেন। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কল-কারখানা, নির্মাণশিল্পে কাজ করা এসব বাংলাদেশিদের প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে পাঠানো সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের দেশের তালিকায় থাকা মালয়েশিয়ার অবস্থান তৃতীয়। শীর্ষ দুটি অবস্থানে রয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ সময়ে মালয়েশিয়া প্রবাসীরা মোট তিন দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা মোট প্রবাসী আয়ের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ।

বেশিরভাগ প্রবাসীরাই এখন ব্যাংকিং চ্যানেলেই টাকা পাঠান। কারণ হুন্ডি ও ব্যাংকিং চ্যানেলে বিনিময় হার প্রায় সমান। উপরন্তু, সরকার ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা প্রবাসী আয়ের ওপর ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। 

তবু এত প্রবাসী আয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অজস্র শ্রমিকের অনিশ্চিত জীবন। অনেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে এলেও আজীবনের জন্য ঋণের জালে জড়িয়ে যান।

তেমনই একজন কুমিল্লার মোহাম্মদ সিয়াম (৩২)। সিয়াম মালয়েশিয়ায় আসার জন্য প্রথমে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেরি হওয়ায় তাকে ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। এরপরেও ভিসা জটিলতার কারণে ছয় সপ্তাহ কাজ পাননি সিয়াম।

এখন তিনি ৪৫-৫০ হাজার টাকা দেশে পাঠান। সিয়াম বলেন, ৬০ ভাগ শ্রমিকই এখন কষ্টে আছে। এর মধ্যে যারা ফ্রি ভিসায় বা দালালের প্রতারণার শিকার হয়ে আসে, তাদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'একদিকে অতিরিক্ত নিয়োগ খরচ, এরপরে আছে কম বেতন, পারমিট নবায়নের খরচ। সব মিলিয়ে শ্রমিকরা ঋণ আর কম বেতনের চক্রেই আটকে যাচ্ছে। বছরে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ২০০ রিঙ্গিত (প্রায় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা) নবায়ন খরচই এখন শ্রমিকদের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অনেকে ১০ শতাংশ হারে মাসিক সুদে ঋণ নিয়ে পারমিট নবায়ন করতে বাধ্য হন।'

ড. রহমান আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া দালাল নির্ভর হওয়ায় এটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এর সমাধানে দ্রুত দ্বিপাক্ষিক সংস্কার দরকার।'

দালাল সিন্ডিকেটে নিয়োগ স্থগিত

২০২৪ সালের ৩১ মে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া স্থগিত করে। তাদের মূলত কয়েকটি বিষয়ে অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে ছিল শ্রমিক নিয়োগে অতিরিক্ত খরচ, অতিরিক্ত শ্রমিকের সরবরাহ এবং ২০২২ সালে নির্বাচিত ১০১টি এজেন্সির সিন্ডিকেট নিয়ে।

এর আগে ২০১৮ সালেও একই কারণে মালয়েশিয়া শ্রমিক নিয়োগ স্থগিত করেছিল।

২০২৪ সালের মার্চে জাতিসংঘের দুই বিশেষ প্রতিবেদকের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশি প্রবাসীদের থেকে সাড়ে চার থেকে ছয় হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়োগ ফি নেওয়া হচ্ছে, যা দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারকে উল্লেখিত ফির (৭২০ ডলার) চেয়ে অনেক বেশি।

এতে করে বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অভিবাসী শ্রমিকদের কাতারে পড়ে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মালয়েশিয়ায় ৯৬ শতাংশ বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ ঋণের কারণে শোষণের ঝুঁকিতে রয়েছে।

সব গল্পই হতাশার নয়

মালয়েশিয়ায় প্রবাসজীবনে কেউ কেউ ভালো চাকরি পেয়ে স্থিতিশীল জীবনও পেয়েছেন।

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর মো. আইউব আলী (২৮) সাত বছর আগে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচে মালয়েশিয়ায় গিয়ে একটি চীনা কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। সময়ের সঙ্গে তার বেতনও বেড়েছে। বর্তমানে তিনি মাসে ৮৬ হাজার ৬০০ টাকা বেতন পান। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৫৭-৬৩ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি দেশে পাঠান।

যেমন: দুই বছর আগে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে সরকারি মালিকানাধীন এক কেবল কোম্পানিতে চাকরি পান ফরিদপুর সদরের মনিরুল ইসলাম (২৮)। তার মাসিক আয় এখন ৬৩-৭৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে খরচ হয় ১৭ হাজার টাকা। বাকি পুরোটাই দেশে পাঠান তিনি।

এই দৃশ্যগুলোতে প্রতীয়মান হয় স্বচ্ছ ও বৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়া শ্রমিকদের শোষণ কমাতে কতটা কার্যকর কার্যকর ভূমিকা রাখে।

নীতিগত পরিবর্তনের দাবি

মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার শাহানারা মনিকা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মালয়েশিয়ায় এখনো উচ্চ অভিবাসন খরচ, প্রতারণা আর শ্রমিক শোষণই সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখনো বড় সমস্যা। তবে সরকার এখন নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সচেতনতা কার্যক্রম ও কনস্যুলার সেবা বাড়াতে নিয়মিতভাবে কাজ করছে।'

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ৮ লাখেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মরত রয়েছে। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে এই সংখ্যা ১৫ লাখের কাছাকাছি। এই প্রবাসীরা মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন নির্মাণ শিল্প, উৎপাদন প্রতিস্থান এবং খাদ্যখাতে কাজ করছেন। যেখানে তাদের বেতন ৪৩ হাজার থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকার মধ্যে।

কিন্তু সাড়ে ৪–৬ লাখ টাকা চুক্তিতে যাওয়া এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই ঋণে জালে ডুবে থাকেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, 'বর্তমানে সরকারি প্রণোদনা ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের কারণে ব্যাংকিং চ্যানেল বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।'

'হুন্ডি নিরুৎসাহিত করতে সরকার আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। ব্যাংক ও মোবাইল অ্যাপে টাকা পাঠানো এখন আগের চেয়ে সহজ ও দ্রুত।'

দূর হয়নি মূল সমস্যা

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, 'প্রবাসীদের অনেকে ভালো আয় করলেও, বিশাল সংখ্যক শ্রমিক এখনো ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। তারা যেখানে জীবনকে উন্নত করতে গিয়েছিল, সেখানে ঋণে ডুবে যাচ্ছে।'

'বিদেশে থাকা শ্রমিকদের সুরক্ষায় দূতাবাসের শ্রম উইংগুলোতে দক্ষ জনবল ও সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।'

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s janaza held

The namaz-e-janaza of BNP Chairperson Khaleda Zia was held at the South Plaza of the Jatiya Sangsad Bhaban today

6h ago