শেয়ারবাজারে সংস্কারের ধাক্কা, বিনিয়োগকারীদের কষ্টের বছর

২০২৫ সালের শুরুতে পুঁজিবাজারে একটু আশা দেখা গিয়েছিল।

গত বছরের আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে পরিবর্তনের আবহ তৈরি হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন, বহুদিন ধরে যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছিল সেগুলো এবার হবে। আর তাতে বাজারে জবাবদিহিতা বাড়বে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তা বাড়বে, আর বাজার হবে আরও ন্যায্য ও স্বচ্ছ।

বাস্তবে কিছু সংস্কারের দেখা মিলেছে। এই যেমন মিউচুয়াল ফান্ড ও মার্জিন ঋণের নতুন নিয়ম করা হয়েছে। নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে। বিও হিসাবের বার্ষিক ফি কমানো হয়েছে।

এছাড়া বাজারে অনিয়মের অভিযোগে আগে যাদের ধরা যেত না, তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সংস্কারের শুরুটা সুখকর ছিল না। জোর করে শেয়ার বিক্রি, বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও শেয়ারের দর পড়তে থাকায় অনেক বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়েন।

ফলে বাজারটা এক রকম অস্থিরতার মধ্যে পড়ে, আর বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করতে থাকে, আদৌ বাজার ঘুরে দাঁড়াবে কি না।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স জানুয়ারির শুরুতে ছিল ৫ হাজার ২০০ পয়েন্টের ওপরে। কয়েক মাসের মধ্যেই তা দ্রুত কমে যায়। সেপ্টেম্বরে আবার কিছুটা বেড়ে ৫ হাজার ৬৩৬ পয়েন্টে ওঠে। তবে ব্যাংক একীভূতকরণ ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণার পর সূচক আবার ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে যায়।

এতে বোঝা যায়, বাজার ও বিনিয়োগকারীরা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খেয়েছে।

এছাড়া সংস্কার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের অনুভূতি ছিল মিশ্র। অনেকেই মনে করেন, বাজারের পুরোনো দুর্বলতাগুলো আগে ঠিক করা দরকার ছিল। তবে সংস্কার কত দ্রুত হবে ও এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত কার ওপর বর্তাবে এই অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের দ্বিধায় ফেলেছিল।

এই দ্বিধা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে আর্থিক খাতে। পাঁচটি ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। আর তালিকাভুক্ত নয়টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আটটিই বন্ধের পথে আছে।

ফেসভেলুর হিসাবে এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

কেবল আর্থিক টাকার ক্ষতিই হয়নি, বরং একীভূতকরণ ও প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে।

বিনিয়োগকারীরা এত দিন ব্যাংক ও আর্থিক প্রকিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট ও ক্রেডিট রেটিংয়ের ওপর ভরসা করে বিনিয়োগ করতেন। বছরের পর বছর এসব প্রতিবেদনে কোনো অনিয়ম ধরা পড়েনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রিচার্ড ডি' রোজারিও বলেন, 'অডিটররা যেসব প্রতিষ্ঠানকে ভালো বলেছে ও ক্রেডিট রেটিং সংস্থাগুলো ভালো রেটিং দিয়েছে মানুষ সেখানে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে।'

সমস্যা কেবল আর্থিক খাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। গত এক দশকে অনেক কোম্পানি বড় আশা নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল।

কিন্তু ২০২৫ সালে এসে দেখা গেল, এর মধ্যে অনেক কোম্পানির পারফরম্যান্স খুবই দুর্বল হয়ে গেছে বা সেগুলোর শেয়ারকে দুর্বল হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই অবনতি বাজার পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত না হওয়া। ২০২৫ সালে একটিও আইপিও বাজারে আসেনি। তাই দুর্বল শেয়ার ধরে রাখা বিনিয়োগকারীদের সামনে তেমন কোনো বিকল্প ছিল না। ফলে তাদের বিনিয়োগ আটকে থাকে এবং নতুন বিনিয়োগের আগ্রহ কমে যায়।

বছরজুড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তৎপরতা ছিল বেশি। মিউচুয়াল ফান্ড সংক্রান্ত নতুন বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়, যা সম্পদ ব্যবস্থাপকরা ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদে ভালো প্রভাব ফেলতে পারে এমন আরও কিছু পরিবর্তনের দাবি জানান তারা।

মার্জিন ঋণের নিয়ম পরিবর্তন করা হয়, লভ্যাংশ দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করা হয় এবং বিও  হিসাবের বার্ষিক ফি ৪৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫০ টাকা করা হয়।

এছাড়া বাজারে কারসাজির অভিযোগে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। এর মধ্যে সাবেক বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবায়াত উল ইসলাম এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও ছিলেন।

বিনিয়োগকারীদের কাছে এটি ছিল একটি বড় পরিবর্তন। কারণ আগে বাজারে আইন প্রয়োগ নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল।

তবে এসব সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে কিছু তাৎক্ষণিক সমস্যার মুখেও পড়তে হয়েছে। ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সংস্কারের প্রভাব শুরুতে সব সময়ই কিছুটা কষ্টদায়ক হয়। দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যায়। আমরা এখন সেই কষ্টের সময়টা পার করছি।'

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, মার্জিন ঋণের নিয়ম বদলানোর ফলে অনেক জায়গায় জোর করে শেয়ার বিক্রি করতে হয়েছে, এতে শেয়ারের দামের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।

মিউচুয়াল ফান্ড খাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নতুন ক্লোজড-এন্ড ফান্ড অনুমোদন বন্ধ করে দেয়। সাইফুল ইসলাম বলেন, এই সিদ্ধান্ত প্রয়োজনীয় ছিল। তবে ওপেন-এন্ড ফান্ড নিয়ে যে আশা করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি পূরণ হয়নি।

আরেকটি হতাশার বিষয় ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে না আনা।

সাইফুল ইসলাম বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টার স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ভালো পারফরম্যান্স করা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনা যায়নি। আমরা বড় একটি সুযোগ হারিয়েছি।'

নতুন আইপিওর জন্য বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ছিল বেশি। কিন্তু ২০২৫ সালে কোনো কোম্পানিই বাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। ভালো মানের শেয়ারের অভাবে থাকা বাজারে এটি বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। অনেকের মনে হয়েছে, সংস্কারের সঙ্গে বাজার বড় করার উদ্যোগ ঠিকভাবে নেওয়া হয়নি।

সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল, আমরা কেউই বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারিনি। বাজার বাড়েনি, আর পুরো ব্যবস্থাটা টেকসই ছিল না।'

এই আস্থাহীনতার প্রভাব লেনদেনেও দেখা গেছে। ২০২৫ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দৈনিক গড় লেনদেন নেমে আসে ৫১০ কোটি টাকায়, যেখানে আগের বছর তা ছিল ৫৬৬ কোটি টাকা।

ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থার প্রভাবও বাজারের তারল্যের ওপর চাপ ফেলেছে। ডিএসইর পরিচালক রিচার্ড ডি' রোজারিও বলেন, 'ফ্লোর প্রাইস পুরো বাজারকেই ভুগিয়েছে।'

তিনি বলেন, অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কার্যক্রম চালু রাখতে বাধ্য হয়ে কম মানের হলেও সহজে কেনাবেচা করা যায় এমন শেয়ারে বিনিয়োগ কররে।

তিনি আরও বলেন, 'গত বছরের আগস্টের পর বাজার আবার একটু নড়াচড়া শুরু করে, বিশেষ করে যেসব শেয়ারের ভিত্তি ভালো ছিল সেগুলোতে। কিন্তু অনেক বিনিয়োগকারী দুর্বল শেয়ারে আটকে থাকায় বাজার পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।'

বছরের শেষে এসে দেখা যায়, কোম্পানির আয় বা মুনাফার চেয়ে বাজার বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল, সংস্কার কত দ্রুত হবে, পুনর্গঠনের সময় শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে, আর ভালো মানের নতুন কোম্পানি কবে বাজারে আসবে।

ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে পুঁজিবাজারের পক্ষে থাকার কথা বলেছে।

এদিকে বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, সমস্যায় পড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডারদের সহায়তায় সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে কমিশন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিসহ নতুন কোম্পানি বাজারে আনতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ চলছে।'

আবুল কালাম জানান, পাবলিক ইস্যু সংক্রান্ত নতুন নিয়ম প্রস্তুত আছে। গেজেট হলে এগুলো ভালো মানের কোম্পানিকে বাজারে আনতে সহায়ক হবে।

তিনি আরও বলেন, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান তহবিল না তুলেও সরাসরি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারবে।

তিনি বলেন, 'একসময় কমিশনের পক্ষে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না। এখন সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। বিএসইসি থেকে এখন আর কাউকে শেয়ার কিনতে বা সূচক বাড়াতে ফোন করা হয় না। এতে অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s body taken to Parliament Complex ahead of janaza

Janaza will be held at Manik Mia Avenue at 2pm

3h ago