একাত্তরে ভাগীরথী নদীর তীরে ‘সুইসাইড স্কোয়াড’

শরীরের সঙ্গে বেঁধে লিমপেট মাইন বহনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নৌ যোদ্ধারা। ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোদের পরিচালিত অপারেশন 'জ্যাকপট' ও 'হটপ্যান্টস' পাকিস্তানি বাহিনীর নৌশক্তিকে কার্যত বিপর্যস্ত করে দেয়। এসব দুর্ধর্ষ অভিযানের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। এই অভিযানের নেপথ্যে ছিলেন বাংলার দামাল ছেলেদের নিয়ে গঠিত এক বিশেষ বাহিনী—নৌ-কমান্ডো দল।

এই নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথী নদীর তীরে। যে মাঠে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেটিই ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তর—১৭৫৭ সালের ২৩ জুন যেখানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটেছিল। একসময় এই অঞ্চলজুড়ে ছিল রানি ভবানীর আম্রকানন।

নদীতীরবর্তী এই মাঠে সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করা হয় নৌ-কমান্ডোদের জন্য অসংখ্য তাঁবু। ভারতীয় নৌবাহিনীর তিনজন অফিসারের সমন্বয়ে গঠিত একটি রিক্রুটিং টিম বিভিন্ন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ঘুরে প্রাথমিকভাবে ৪৮০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করেন।

১৯৭১ সালের ১১ জুন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাগীরথী নদীর তীরে স্থাপিত এই ক্যাম্প পরিদর্শনে যান। তার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী।

সেখানে নৌ-কমান্ডোদের উদ্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'নৌ-কমান্ডো অপারেশনের সফলতার ওপরই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়সীমা নির্ধারিত হবে। নৌ-কমান্ডো মানে সুইসাইড স্কোয়াড। এর মানে একশ ভাগ মৃত্যু। এই কথা মাথায় রেখেই তোমাদের এই কঠিন প্রশিক্ষণ নিতে হবে। যারা এই স্কোয়াডে যোগ দিতে আগ্রহী নও, তারা চলে যেতে পারো।' (মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো: পলাশী, কর্ণফুলী ও কলকাতা, সাজেদুল হক; পৃ. ৪২)

এই বক্তব্যের পর ৪৮০ জনের মধ্যে ৩৪৫ জনই প্রশিক্ষণ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। যে ট্রাকে করে তাদের আনা হয়েছিল, সেই ট্রাকেই তাদের ফেরত পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত ১৩৫ জন এই ভয়ংকর প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

পলাশীর এই নৌ-কমান্ডো ক্যাম্পটি নিয়ন্ত্রণ করত ভারতীয় নৌবাহিনী। ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জি এম মার্টিস। প্রশিক্ষণ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন লেফটেন্যান্ট এ কে দাস ও লেফটেন্যান্ট কপিল।

এই ক্যাম্পেই যোগ দেন ফ্রান্স থেকে জীবন বাজি রেখে পালিয়ে আসা আটজন বাংলাদেশি সাবমেরিনার।

তারা হলেন—আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, আবদুর রাকিব মিয়া, সৈয়দ মোশারফ হোসেন, মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ, আহসানউল্লাহ, আমিনউল্লাহ শেখ, আবদুর রহমান ও বদিউল আলম।

১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার ফ্রান্স থেকে তিনটি আধুনিক সাবমেরিন কেনে। এর একটি ছিল পিএনএস ম্যানগ্রো। ৫৭ জন নাবিক নিয়ে এই সাবমেরিন পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি দল ফ্রান্সে যায়, যার মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি।

বিবিসির সূত্রে মুক্তিযুদ্ধের খবর পেয়ে আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে নয়জন পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পিতভাবে সাবমেরিনের কয়েকটি কক্ষ বাইরে থেকে আটকে তারা পালান। নানা পথ পেরিয়ে স্পেনের মাদ্রিদে পৌঁছে ভারতীয় দূতাবাসের সহায়তায় আটজন ভারতে আসতে সক্ষম হন। দলের অন্য একজন ভুল পথে লন্ডনে চলে যান।

পরবর্তীতে নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণে যোগ দেওয়া যোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের ছাত্র, পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার তরুণ-যুবকরা। নদীমাতৃক বাংলার খরস্রোতা নদীগুলোতে সাঁতারে অভ্যস্ত এই যুবকেরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে মাইলের পর মাইল সাঁতার কাটতে পারতেন। কখনো বাঁশ বা পেঁপে পাতার তৈরি চোঙা দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে পানিতে মাইন বহন করে শত্রুপক্ষের কাছে রেখে বিস্ফোরণের আগেই নিরাপদ দূরত্বে ফিরে আসতেন।

এই দুঃসাহসী অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় দৈহিক ও মানসিক দৃঢ়তা পূর্ব বাংলার তরুণদের মধ্যে ছিল প্রচুর। শুরুতে নৌ-কমান্ডো বাহিনীর নেতৃত্ব নৌবাহিনীর সদস্যদের হাতে থাকলেও অল্প সময়েই তা চলে যায় উদ্দীপিত শিক্ষিত যুবকদের হাতে। তাদের সাহস আর প্রাণশক্তিই এসব বিপজ্জনক অভিযানের চালিকাশক্তি ছিল।

এই সাঁতারু যোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। অল্পসংখ্যক হিন্দু যোদ্ধা খতনা করেছিলেন—ধরা পড়লে অন্তত প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা থাকবে, এমন বিশ্বাস থেকে।

বাংলার নৌ যোদ্ধাদের ফিনস ব্যবহার শেখাচ্ছেন প্রশিক্ষক। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদিন ভোরে শুরু হতো প্রশিক্ষণ। হালকা ব্যায়াম ও নদীর পাড় ধরে দৌড়ানোর পর সকালের নাশতা। সকাল আটটায় জাতীয় সংগীত ও শপথ পাঠ। নয়টায় সুইমিং কস্টিউম পরে ভাগীরথী নদীতে সাঁতার। প্রথম এক ঘণ্টা নদীতে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল না। দশটায় গলাপানিতে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিট বিশ্রাম, গ্লুকোজ পানি পান। এরপর আবার গভীর জলে সাঁতার চলত দুপুর ১২টা পর্যন্ত।

দুপুরের খাবারের পর বিকেল তিনটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত ক্লাস, সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত কমব্যাট জুডো। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত আবার নদীতে সাঁতার।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণ আরও কঠিন হয়। শব্দ না করে নদীতে নামা, সাঁতরানো, তীরে ওঠা—সবকিছুই নিঃশব্দে করতে হতো। চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর বন্দরের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর নৌযোগাযোগ ছিন্ন করাই ছিল নৌ-কমান্ডোদের মূল লক্ষ্য।

এই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌ যোদ্ধা আতহার উদ্দিন তালুকদার তার বই ১৯৭১: কীর্তনখোলায় নৌযুদ্ধ-এ লেখেন, 'ক্যাম্পটি ছিল শান্ত ও নীরব। উত্তরে ভাগীরথী নদী সাগরের দিকে ছুটে চলেছে। আখক্ষেত আর বাবলা গাছ ঘেরা এই মাঠেই চলত আমাদের পিটি, দৌড়, কুস্তি। অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে আমাদের চঞ্চল মন আরও উচ্ছল হয়ে উঠত।' (পৃ. ৫৫)

নৌ-কমান্ডো মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রশিক্ষণ শুরুর আগে বন্ড পেপারে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল—যুদ্ধে মৃত্যু হলে কেউ দায়ী নয়। প্রতিদিন প্রায় ১৮ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ চলত। বর্ষাকালে নদীতে মৃতদেহ, বিষাক্ত সাপ, তীব্র স্রোতের মুখে সাঁতার—সবই ছিল বাস্তবতা। অনেকেই ক্লান্তিতে ডুবে যেতেন, তখন রেসকিউ টিম উদ্ধার করত। (মুক্তিযুদ্ধে নদী, ফয়সাল আহমেদ; পৃ. ১৩২)

১৯৭১ সালের মে মাস থেকে চরম গোপনীয়তার সঙ্গে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বিভিন্ন মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প থেকে বাছাই করা যোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে ওঠে নৌ-কমান্ডোদের এই 'সুইসাইড স্কোয়াড'। পরবর্তীতে তারাই জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর নৌশক্তি ধ্বংস করে স্বাধীনতার পথ সুগম করেন।

এভাবেই ভাগীরথী নদীর তীরে প্রশিক্ষণ নেওয়া সেই তরুণদের হাত ধরেই জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্র।

Comments