মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের খাইয়ে না খেয়ে থাকতে হয় ফাতেমার

আসলাম মিয়ার একমাত্র সম্পদ এই টিনশেড ঘরটি। ছবি: সংগৃহীত

গত ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত সপ্তাহের প্রায় প্রতি সোমবার রাতেই সবজি ব্যবসায়ী আসলাম মিয়ার বাসায় বিশেষ খাবারের আয়োজন হতো।

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের বাড়িতে তার তিন সন্তান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত বাবার জন্য। বাবা ঢাকায় সবজি বিক্রি করে বড় মাছ বা মাংস কিনে বাড়ি ফিরবেন।

আসলাম অবশ্য প্রায়ই খেলনা, বিশেষ খাবার কিংবা ফল নিয়ে গিয়ে সন্তানদের চমকে দিতেন।

কিন্তু গত ১৩ ডিসেম্বর পাল্টে যায় গফরগাঁওয়ের রৌহা গ্রামের এই পরিবারটির অবস্থা।

সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী অবরোধের মধ্যে দুর্বৃত্তরা গাজীপুরে রেললাইন কেটে ফেললে ঢাকায় যাওয়ার পথে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হলে মৃত্যু হয় আসলামের।

একমাত্র উপার্জনকারীর হঠাৎ মৃত্যুতে দুর্দশা ও হতাশায় পড়ে পরিবারটি।

আসলামের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন বাচ্চাদের তিন বেলা খাওয়াতে অন্যদের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।'

পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়েছে ফাতেমাকে।

কঠোর পরিশ্রম করে আসলাম পরিবারটিকে আগলে রেখেছিলেন। স্থানীয় বাজার থেকে শাক-সবজি কিনে ঢাকায় বিক্রি করতেন।

ফাতেমা বলেন, 'আমরা ভালোই ছিলাম। কিন্তু এখন তো চরম খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি।'

আসলাম মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আয়ের একটা অংশ সঞ্চয়ও করেছিলেন আসলাম।

ফাতেমা বলেন, 'কিন্তু এখন আমাকে প্রতিদিন ভাবতে হয় কীভাবে বাচ্চাদের খাওয়াব। কীভাবে তাদের পড়াশোনার খরচ চালাব, তা তো ভাবতেই পারি না।'

'ভালো খেয়েছি, ভালো কাপড় পরেছি। এখন অবস্থা এমন যে, একবেলা খেলে পরের বেলার কথা ভাবতে হয়', বলেন তিনি।

মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের খাওয়াতে গিয়ে ফাতেমাকে না খেয়ে থাকতে হয় বা কম খেতে হয়।

ফাতেমা কখনো ভাবেননি যে, তিনি বা তার সন্তানরা এমন অবস্থায় পড়বে।

তিনি সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করেছেন।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের পরিবারটিকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতিবেশীরাও কিছু কিছু সহায়তা করেছে। গত চার মাসের বেশি কঠিন এ সময়ে যা কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে পরিবারটিকে।

গফরগাঁও সমাজসেবা কার্যালয় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা দিয়েছে। রিকশা ভাড়া বাবদ দৈনিক ১৮০ টাকা পান ফাতেমা।

তিনি বলেন, 'রোজার মাসে আমি বাচ্চাদের ভালো করে খাওয়াতে পারিনি। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় এমন কখনো হয়নি।'

২০০৫ সালে আসলামের সঙ্গে ফাতেমার বিয়ে হয়। তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে নাহিদ হাসান শুভ স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী, মেয়ে আরিফা আক্তার সুবর্ণা একটি মাদ্রাসায় পড়ে। তারা বুঝতে পেরেছে যে তাদের বাবা মারা গেছে এবং আর কখনো ফিরে আসবে না।

কিন্তু, তিন বছর বয়সী আবু রায়হান তো এতকিছু বোঝে না। মাঝেমধ্যেই সে বাবার কবরের সামনে গিয়ে ডাকে।

সাড়া না পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে, 'মা, বাবা আসে না কেন? সবার বাবা বাসায় আসে, আমার বাবা আসে না কেন?'

নাহিদ হাসান শুভ ও আবু রায়হান। ছবি: সংগৃহীত

ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'তাকে দেওয়ার কোনো উত্তর নেই আমার কাছে।'

আসলামের মা ও তার দুই বোনও তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। বড় ছেলেকে হারিয়ে মা এখনো শোকাগ্রস্ত এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ছেলের কথা ভেবে প্রায়ই তিনি কেঁদে ওঠেন।

আসলামের মৃত্যুর পর বিভিন্ন মহল থেকে তার পরিবার আর্থিক সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস পায়। কিন্তু ফাতেমা জানান, এখনো সহায়তা পাননি তারা।

তিনি বলেন, 'আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। বিনা দোষে তাকে হত্যা করা হয়েছে। যদি তারা রেললাইন না কাটত, আমার বাচ্চারা এতিম হতো না।'

'আমি বিচার চাই, যারা আমার সন্তানদের এতিম করেছে তাদের শাস্তি চাই', বলেন তিনি।

কিন্তু ফাতেমা জানেন, ন্যায়বিচার পেলেও তার কষ্ট কমবে না। কে নেবে তার পরিবারের দায়িত্ব।

Comments

The Daily Star  | English

This time our fight is against corruption

From its mammoth rally in Dhaka yesterday, the Jamaat-e-Islami vowed to wage war on corruption if it gets the people’s mandate in the next general election.

1h ago