সরকারি রেকর্ডে অদৃশ্য সম্প্রদায় মান্তা, জীবন কাটে নদীতে

ছবি: টিটু দাস

সারিবদ্ধভাবে পাশাপাশি নোঙর করা কয়েকটি নৌকা। স্রোতের সঙ্গে মৃদু তালে নৌকাগুলো দুলছে। এই দৃশ্যের দেখা মেলে বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাটে আড়িয়াল খাঁ নদে। একই দৃশ্য দেখা যায় বুখাইনগরের কাছে কালাবদর নদীতে।

এসব নৌকা মান্তা সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রজন্মের প্রজন্ম ধরে সম্পূর্ণভাবে নদীর পানিতে জীবনযাপন করে আসছে। মাছ ধরা তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। 

ছোট ছোট জাল এবং ঐতিহ্যবাহী বড়শি ব্যবহার করে এই সম্প্রদায়ের লোকেরা মাছ ধরেন। তারা ভোরে বেরিয়ে পড়েন। সারা দিনে নদীতে যা পাওয়া যায়, সন্ধ্যায় তা নিয়ে ফিরে আসেন। প্রতিটি নৌকা বহরের একজন সর্দার থাকেন। তিনি দৈনন্দিন বিষয়গুলো দেখভাল করেন।

নদীতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস সত্ত্বেও মান্তারা সরকারি রেকর্ডে অদৃশ্য রয়ে গেছেন। তাদের নেই কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র, নেই কোনো মাছ ধরার কার্ড। সরকারের কোনো সহায়তা তারা পান না। তাদের সন্তানদের জন্য কোনো স্কুল নেই, অসুস্থদের জন্য কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।

তাদের নিজস্ব কোনো জমি নেই। নদীর পানির ওপর ভাসমান নৌকায় তাদের জন্ম হয়। মৃত্যুও হয় একই জায়গায়। যেভাবেই চিন্তা করা যায়, তারা মূলত ভাসমান মানুষ।

বরিশাল শহর থেকে মাত্র ছয় থেকে সাত কিলোমিটার দূরে চরমোনাই ইউনিয়নে কালাবদর নদীতে মান্তাদের দুটি বহর নোঙর করা আছে। আরেকটি বহর নোঙর করা আড়িয়াল খাঁ নদে। সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং স্থানীয় এনজিওর তথ্য অনুসারে, এই তিনটি ক্লাস্টারে ৩৫০ জনেরও বেশি মান্তা বাস করেন।

সম্প্রতি এই সংবাদদাতা বুখাইনগর ও লাহারহাটে ৫০ জনেরও বেশি মান্তা পুরুষ ও নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন। বেশির ভাগই বলেন, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। নেই মাছ ধরার সরকারি কার্ড। কেউ কোনো সুরক্ষাভাতাও পান না। তারা বলেন, প্রায়শই তারা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের কাছে সাহায্য চাইতে যান। স্থলের বিপরীতে নদীতে নৌকায় বাস করে বলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

বুখাইনগরের ১৮ বছর বয়সী মর্জিনা বেগম  হৃদয়বিদারক এক ঘটনা স্মরণ করে বলছিলেন, 'ছয় মাস আগে আমার ছেলের ঠান্ডা লেগেছিল। আমি তাকে স্থানীয় একটি ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ পরে সে মারা যায়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের কাছে টাকা ছিল না।'

এই মান্তা নৌবহরের সরদার আইয়ুব আলী বলেন, 'এই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ পুরুষ ও নারী নিরক্ষর। তারা ফোনকল রিসিভ করতে পারেন। কিন্তু  নম্বর চেপে কল দিতে পারেন না। এখানকার শিশুরা স্কুলে যায় না। আমাদের নারীদের সাধারণত চার বা পাঁচটি সন্তান থাকে, কিন্তু কেউ তাদের সন্তানদের বয়সও বলতে পারেন না।'

এই বহরে মোট ৪৪টি নৌকা রয়েছে। এসব নৌকায় এমন পরিবার রয়েছে, যাদের পুরো জীবনই কেটেছে নৌকায়। এই বহরে যারা থাকেন মধ্যে মাত্র দুজন পুরুষ— আইয়ুব আলী এবং দুলাল সরদারই টাকা গুনতে পারেন। নারীরা টাকা গুনতে পারেন না।

বেশিরভাগ নৌকায় সোলার লাইটের ব্যবস্থা থাকে। অর্ধেক নৌকায় ছোট ছোট টিভি আছে। প্রায় সব পরিবারের কাছেই আছে মোবাইল ফোন। এই মান্তা বহরের তরুণরাও পড়তে, লিখতে বা নম্বর ডায়াল করতে পারেন না। তবে তারা নোট চেনেন। 

মান্তা সম্প্রদায়ের শিশুরা খুব ছোটবেলাতেই নদীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়। তারা হাঁটতে শেখার পরই স্বাভাবিকভাবে নদীতে সাঁতার কাটতে ও নৌকা চালাতে শেখে। তাদের কেউই কখনও শ্রেণীকক্ষের ভেতরটা দেখে না।

লাহারহাটে সূর্যাস্তের আলোয় নদী ঝলমল করছে, আর নৌকাগুলো পানির ওপর মুক্তোর মতো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। নারীরা নৌকায় বসে বাসন মাজছেন, আর পুরুষেরা জাল মেরামত করছেন। তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে নির্দিষ্ট ছন্দ। তবুও তারা সরকারি বা সামাজিক স্বীকৃতি থেকে দূরে।

সেখানে কথা হয় মান্তা নৌবহরের নেতা হাফেজ সরদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমরা ভূমিহীন। আমরা অনেকবার জমি চেয়েছি, কিন্তু কেউ সাহায্য করে না। কেউ মারা গেলেও আমাদের স্থানীয় চেয়ারম্যানদের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়।'

পাঁচ সন্তানের মা আলেয়া বেগম নিজের সন্তানদের নাম বলতে পারলেও বয়স বলতে পারলেন না। আঙুলে গোনার কথা বললে এক মুহূর্ত থমকে হয়ে লাজুক হাসি দিলেন। সম্প্রদায়ের অধিকাংশ নারী ও কিশোরী এই একই নীরব সংগ্রামের মধ্যে দিন কাটান।

স্থানীয় এনজিওগুলোর হিসাব অনুযায়ী, বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালী জেলায় প্রায় আট থেকে ১০ হাজার মান্তা বসবাস করেন। তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন চন্দ্রদ্বীপ উন্নয়ন সমিতি জানায়, শুধুমাত্র বরিশাল সদর উপজেলায় প্রায় এক হাজার মান্তা বসবাস করেন।

বরিশাল সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজহারুল ইসলাম বলেন, মান্তা সম্প্রদায় থেকে কোনো সরকারি খাস জমির জন্য আবেদন তিনি পাননি।

মান্তা নারীরা নৌকাতেই সন্তান প্রসব করেন প্রাকৃতিকভাবে, কোনো ধরনের চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াই। যদি জটিলতা দেখা দেয়, তারা স্থানীয় দোকান থেকে কেনা ওষুধের ওপর নির্ভর করেন। নবজাতক নদীতে পড়ে না যাওয়ার জন্য অনেক মা তাদের সন্তানদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন।

সম্প্রতি লাহারহাটে অন্তত দুই মান্তা শিশু নদীতে ডুবে মারা গেছে। জানাচ্ছিলেন নৌবহরের নেতা জসীম সরদার।

'আগে কেউ মারা গেলে আমরা লাশ পানিতে ভাসিয়ে দিতাম,' দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন ৬০ বছর বয়সী কদমজান বিবি। তিনি বলেন, 'এখন চেয়ারম্যান অনুমতি দিলে আমরা স্থলে কবর দিই। আমরা পানির ওপরই জন্মাই, পানির ওপরই মরে যাই — এটাই আমাদের নিয়তি।'

মান্তা সম্প্রদায়ের প্রায় প্রতিটি শিশু প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া বেড়ে ওঠে। এনজিওকর্মীদের মতে, মান্তা সম্প্রদায়ের প্রায় ১০০ শতাংশ মানুষই নিরক্ষর। সম্প্রতি চারটি ছোট ডে-কেয়ার সেন্টার চালু হয়েছে, যেখানে প্রায় ১৫০ শিশুকে ছড়া শেখানো হয় এবং সংখ্যা গণনার প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়।

একটি ডে-কেয়ার সেন্টারের সহশিক্ষক অর্চনা রাণী মিস্ত্রি বলেন, 'এই শিশুরা শেখার জন্য উৎসাহী। কিন্তু তাদের পরিবার স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য রাখে না। তারা নৌকা নিয়ে চলাফেরা করে, তাই শিশুরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না।'

মান্তা মেয়েদের সাধারণত ১৪ বা ১৫ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। তাদের শৈশব খুব স্বল্প। খুব অল্প বয়সেই তারা  মাছ ধরা, রান্না, নৌকা চালানো বা ছোট ভাই-বোনের দেখভাল করার মতো কাজে লেগে পড়ে।

স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম

মান্তারা সরকারিভাবে জেলে হিসেবে স্বীকৃত নন। চলমান ২২ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় তারা রেশন বা সরকারি সহায়তা পান না। গত সপ্তাহে শতাধিক মান্তা পুরুষ ও নারী ত্রাণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে মুলাদী উপজেলা মৎস্য অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন।

সেখানে আইয়ুব আলী নামে এক মান্তা বলেন, 'নদীতেই আমাদের জন্ম, নদীতেই মৃত্যু। মাছ ধরা আমাদের একমাত্র কাজ। কিন্তু যখন নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়, তখন আমাদের কাছে কোনো খাবার থাকে না। কেউ আমাদের সাহায্য করে না। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ কেবল বেঁচে থাকার জন্য রাতে গোপনে মাছ ধরতে বাধ্য হন।'

সরকারি রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় এক লাখ ৪৩ হাজার ৪৩৮টি জেলে পরিবার সাহায্য হিসেবে চাল পাচ্ছে। তাতে মান্তারা নেই। তাদের অনেকে জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছেন।

স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, নিবন্ধিত জেলেদের মাত্র ৮০ শতাংশ সরকারি সহায়তা পান। মান্তারা বাদ পড়ে যান, কারণ তারা কখনও নিবন্ধিত হননি।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিসুজ্জামান বলেন, 'তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যান। এ কারণেই চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্যরা তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে দ্বিধায় থাকেন।'

সন্ধ্যার ম্লান আলোয় আড়িয়াল খাঁ নদ তামার মতো জ্বলজ্বল করে। নৌকার পাশে শিশুদের হাসির শব্দ নদের পানিতে প্রতিধ্বনিত হয়। নারীরা ছোট মাটির চুলায় রাতের খাবার রান্না করেন। আর পুরুষেরা আরেকটি অনিশ্চিত দিনের জন্য তাদের জাল মেরামত করতে থাকেন। 

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মান্তা সম্প্রদায় দক্ষিণ বাংলাদেশের নদীর ওপর জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে। তারা রাষ্ট্রহীন, ভূমিহীন এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য। তাদের জীবন নদীর সঙ্গে বইতে থাকে। অন্যরা স্বাভাবিকভাবেই যে অধিকার ভোগ করে, মান্তারা তা পান না।

বরিশালের সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, 'শিক্ষা, পরিচয়পত্র বা সরকারি সহায়তার অভাবে মান্তা সম্প্রদায় দেশের সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অদৃশ্য গোষ্ঠীর মধ্যে একটি।'

তিনি আরও বলেন, 'মান্তাদের নেই জমি, নেই স্কুল, নেই হাসপাতাল, নেই কোনো স্বীকৃতি। তারা নদীর মানুষ। নদীর পানিতে নৌকায় তাদের জন্ম, সেখানেই তারা বেঁচে থাকেন, সেখানেই তারা মারা যান। তাদের দিকে কারো মনযোগ নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

2h ago