ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রাকসু এজিএস প্রার্থীদের

জাহিন বিশ্বাস এষা, শাহ পরান লিখন, নাসিম সরকার ও মাহাইর ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৬ জন। প্রার্থীরা তাদের মতো করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে যাওয়ায় বেড়েছে প্রচারণার সময়।

চার প্রার্থীর সঙ্গে আলাপ করে তাদের প্রতিশ্রুতি ও সেগুলো বাস্তবায়নে তাদের ভাবনার কথা জেনেছে দ্য ডেইলি স্টার।

শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়ে সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার এষার

শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হয়ে কাজ করতেই রাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাহিন বিশ্বাস এষা।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মনোনীত 'ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম' প্যানেলের এই প্রার্থীর মতে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর নারী শিক্ষার্থীরা নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে নারী নেতৃত্বকে সামনে আনা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

এষা বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে তিনি আগে কাজ করেছেন, ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। তিনি মনে করেন, প্রশাসনের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।

জয়ী হলে ক্যাম্পাসে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থান গড়ে তোলার পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে মনোযোগ দিতে চান এষা। তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের জন্য পার্টটাইম চাকরির সুযোগ ও আবাসন সংকট নিরসনে রোডম্যাপ তৈরি করব।'

পাশাপাশি চিকিৎসা কেন্দ্রের আধুনিকায়ন, ২৪ ঘণ্টা খোলা ফার্মেসি চালু, নিরাপদ পানি ও খাবার নিশ্চিতকরণ এবং নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও অনলাইন হ্যারেসমেন্ট প্রতিরোধে সাইবার সেলকে কার্যকর করার বিষয়েও কাজ করতে চান তিনি।

পারফর্মিং আর্টিস বিভাগের শিক্ষার্থী এষা বলেন, 'আমি আকাশকুসুম চিন্তা করছি না। ক্যাম্পাসের মৌলিক সমস্যা নিয়েই কাজ শুরু করতে চাই। নিরাপত্তা ও শিক্ষার্থীদের জরুরি সেবা নিশ্চিত করাই হবে আমার প্রধান লক্ষ্য।'

'আমি মনে করি শিক্ষার্থীদের প্রতিটি যৌক্তিক দাবিগুলো নিয়ে কাজ করতে পারব। আর সবাইকে নিয়ে আমি কাজ করতে চাই, অন্তত তাদের হয়ে যদি কথা বলতে পারি, যে সমস্যাগুলোর সমাধান এখনো হচ্ছে না, প্রশাসনকে চাপ দিয়ে আমরা একসঙ্গে সেগুলো সমাধান করতে পারব,' বলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন চান শাহ পরান লিখন

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শাহ পরান লিখন নিজের প্রার্থিতাকে দেখছেন এক ধরনের 'কাফফারা' হিসেবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব ছাত্রসংগঠনেগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া ভুল ছিল বলে মনে করেন তিনি।

লিখন বলেন, 'পাঁচ আগস্টের পর যাদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলাম, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছুই করতে পারেনি এবং বুঝে গেছি সামনেও তারা পারবে না।'

'রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয় প্রভাবমুক্ত অটোনমি নিশ্চিত না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন সম্ভব নয়। খাতা-কলমে অটোনমি থাকলেও বাস্তবে তা নেই। ছাত্রদল, শিবির বা অন্য সংগঠনগুলো এখনো তাদের মাদার অর্গানাইজেশন ও স্থানীয় রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল,' বলেন তিনি।

এই স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, 'আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩ বছরে পা দিলেও এখনো আবাসন সংকট, নিম্নমানের খাবার কিংবা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাবই ছাত্ররাজনীতিকে বাজে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হলে সিট দেওয়া বা চ্যারিটির মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহের রাজনীতি বন্ধ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।'

জয়ী হলে কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার ইশতেহার একটাই সেটা হলো "সেলফ সার্ভিস"—অর্থাৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোডম্যাপ প্রণয়ন এবং সেই দাবিতে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালানো। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্নাঙ্গ ও প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের জন্যই আমি এজিএস পদে লড়ছি।'

শিক্ষার্থীদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নাসিমের

গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ প্যানেলের প্রার্থী নাসিম সরকার মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন শিক্ষকদের আধিপত্য দূর করে শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমতা পৌঁছে দেওয়া।

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে রাজপথ থেকে প্রশাসনিক দপ্তর পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে আসা ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক সংকটগুলোর মূল কারণ দলীয়করণ ও ফ্যাসিবাদী দখলনীতি। প্রশাসনে দলীয় নিয়োগ, হলে সিট বণ্টন বা ডাইনিংয়ে নিম্নমানের খাবার—এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব শুধু শিক্ষার্থীদের হাতে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।'

'আমরা চাকচিক্যময় প্রতিশ্রুতির পথে যাচ্ছি না। বরং সমস্যার মূল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী কাজ করতে চাই,' বলেন তিনি।

নাসিম বলেন, 'আওয়ামী লীগের আমলে হলে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবাসিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতো। তখন নানা দমন-পীড়নের শিকার হলেও আমরা শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছি। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানেও আমরা সামনের সারিতে ছিলাম। শিক্ষার্থীরা আমাদের সেই ভূমিকা দেখেছেন, সেখান থেকেই আমার আস্থা—শিক্ষার্থীরা এবারও আমাদের হিসেবে বেছে নেবেন।'

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সামন্তীয় কালচার প্রচলিত, যেখানে শিক্ষার্থীদের দেখা হয় প্রজা ও শিক্ষকরা রাজা, আমি এই প্রথা ভাঙতে শিক্ষকদের মান নির্ধারণে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন রেটিং ব্যবস্থার সুযোগের প্রচলন করতে চাই।'

এছাড়া, ছাত্রলীগসহ ফ্যাসিবাদী তৎপরতা স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে করপোরেট নির্ভরতা বাতিল, শিক্ষার্থীদের জন্য খণ্ডকালীন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

নাসিম বলেন, 'হাসিনার মতো শক্তিশালী ফ্যাসিস্টকে শিক্ষার্থীরা যখন হটাতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয়করণ বা দমননীতির মতো সমস্যাও তারা সমাধানে সক্ষম। আমরা সেই শক্তিকে স্থায়ী রূপ দিতে চাই।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব নয়, একাডেমিক উৎকর্ষতা দেখতে চান মাহাইর

নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি 'রাজনৈতিক ক্যাম্পাস' নয়, বরং 'একাডেমিক উৎকর্ষের ক্যাম্পাস' হিসেবে গড়ে তোলার লড়াই করবেন সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থী মাহাইর ইসলাম।

আরবি বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাস সবসময় রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে বাঁধা পড়ে আছে। কিন্তু একাডেমিক উৎকর্ষের ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে। আমি চাই সেটা আবার ফিরিয়ে আনতে।'

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এই সমন্বয়ক জানান, তিনি সবসময় শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন। ফি কমানোর আন্দোলন, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন কিংবা ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতির মতো ইস্যুতে তিনি সামনের সারিতে ছিলেন।

তিনি বলেন, '২৪-এর অভ্যুত্থানের পরে শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশা করেছিল ছাত্ররাজনীতির সংস্কৃতি বদলাবে। কিন্তু দেখা গেল রাজনৈতিক দলগুলো আবারও সহিংসতায় ফিরছে। আমরা সেই ধারা থেকে নিজেদের আলাদা রেখেছি।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ সমস্যার কথা উল্লেখ করে মাহাইর বলেন, 'নির্বাচিত হলে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে প্রশাসনকে বাধ্য করব, হলে সিট বণ্টনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করব, অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ভাতা চালু করব, ডাইনিংয়ের খাবারের মানোন্নয়নে তদারকির ব্যবস্থা করব, টিএসসির পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো উন্নয়ন করব।'

শিক্ষকদের মানোন্নয়নে তিনিও শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষকদের নিয়োগে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রণয়নের ভাবনা তার।

মাহাইর বলেন, 'রাজনীতি দিয়ে নয়, গবেষণা ও জ্ঞান উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে হবে। আমার লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের হাতে একাডেমিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া।'

Comments

The Daily Star  | English
The Costs Of Autonomy Loss of Central Bank

Bangladesh Bank’s lost autonomy has a hefty price

Economists blame rising bad debt, soaring prices and illicit fund flows on central bank’s waning independence

13h ago