নতুন রূপ, পুরনো দ্বন্দ্ব: ভারত–পাকিস্তান মহারণ

ভারত আর পাকিস্তান মাঠে নামলেই তা কেবল একটি খেলা থাকে না, খেলাকে ছাপিয়ে যায় দুই দেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ইতিহাসের বোঝা আর পারস্পরিক অবিশ্বাসের ছায়া।
এশিয়া কাপ ২০২৫–এও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন সূর্যকুমার যাদবের নেতৃত্বাধীন ভারত আজ রাতে মুখোমুখি হবে সালমান আলি আগার পাকিস্তানের বিপক্ষে।
অন্য অনেক বড় টুর্নামেন্টের মতো, রাজনীতি এবারও রেহাই দেয়নি এই আসরকে। আট দলের এই ১৭তম আসর আয়োজনের কথা ছিল ভারতে। কিন্তু এ বছরের শুরুতে পাহেলগাও ঘটনার পর দুই দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে গিয়ে ঠেকায়, পাকিস্তানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আয়োজক ভারত বাধ্য হয় প্রতিযোগিতা সরিয়ে নিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এএসসি) আবারও সূচি সাজিয়েছে এমনভাবে যাতে ভারত–পাকিস্তান লড়াই যতবেশি সম্ভব হয়। 'এ' গ্রুপে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের সঙ্গে রাখা হয়েছে দুই দলকে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে তারা একাধিকবার মুখোমুখি হবে, ফাইনালেও দেখা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ (২০০৯ সালের মুম্বাই হামলার পর থেকে), তাই বহুপাক্ষিক আসরেই এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে, পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হবে না, তবে বহুপাক্ষিক আসরে অংশগ্রহণে কোনো বাধা নেই, এ নীতি প্রায় স্থায়ী রূপ নিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
ক্রিকেটীয় দিক থেকে দেখলে দুই দলই এবার এসেছে নতুন চেহারায়। মুখ বদলালেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধার কমেনি; বরং নতুন রূপে সেটা যেন আরও শাণিত হয়েছে।
ভারতের জন্য এশিয়া কাপ মানেই রোহিত শর্মা–বিরাট কোহলির যুগ-পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা। ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী দলে সাতটি পরিবর্তন এসেছে, যা ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ অভিযানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই ধরা হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি নজর ওপেনিংয়ে। দুর্দান্ত আইপিএল শেষে ফিরেছেন ভাইস–ক্যাপ্টেন শুবমান গিল। এর আগে জিম্বাবুয়ে সফরে পাঁচ ম্যাচেই অভিষেক শর্মার সঙ্গে ওপেন করেছিলেন তিনি। তবে গত এক বছরে ১২ ম্যাচে টানা ওপেনিং করেছেন অভিষেক ও সঞ্জু স্যামসন। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ছিল দারুণ, ২০২৫ সালে অভিষেকের গড় ৫৫.৮০, স্ট্রাইক রেট ২১৯.৬৯; অন্যদিকে স্যামসন ২০২৪ সালে ক্যালেন্ডার ইয়ারে তিনটি টি–টোয়েন্টি সেঞ্চুরি করে ইতিহাস গড়েছেন। তবু তাদের জুটির সর্বোচ্চ জুটি ছিল মাত্র ৭৩ রান। গিলের ফেরায় নির্বাচনে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর ওপর যশস্বী জয়সওয়ালকে বাদ দেওয়ায় সমালোচনা আরও বেড়েছে।
মিডল অর্ডারে ভারতের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ -সূর্যকুমার যাদব, তিলক ভার্মা, হার্দিক পান্ডিয়া, আকসার প্যাটেল, রিঙ্কু সিং, শিবম দুবে ও জিতেশ শর্মা। তাই ব্যাটিং গভীরতা আর বোলিং ভারসাম্য বজায় রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
পেস আক্রমণে জসপ্রিত বুমরাহ আর অর্শদীপ সিং নিশ্চিত নাম। স্পিন আক্রমণ নির্ভর করছে কুলদীপ যাদব ও বরুণ চক্রবর্তীকে ঘিরে।
অন্যদিকে পাকিস্তান এখনো খুঁজছে স্থিরতা। ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে বাদ পড়ার পর থেকে তারা ২৬ ম্যাচে জয় পেয়েছে মাত্র ১২টিতে। জিম্বাবুয়ে, বাংলাদেশ (নিজেদের মাটিতে) আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারালেও অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশ সফরে তারা হেরেছে।
তবে প্রস্তুতিতে তারা ভারতের চেয়ে এগিয়ে। এশিয়া কাপের ঠিক আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আফগানিস্তানকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতেছে পাকিস্তান। অন্যদিকে ভারত এ বছর কেবল পাঁচটি ম্যাচ খেলেছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাছাড়া পাকিস্তানের সব গ্রুপ ম্যাচ দুবাইতে, যেখানে গত ১৩ ম্যাচে তারা মাত্র চারটিতে হেরেছে, যা আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে দলকে।
ব্যাটিং নিয়েই মূল প্রশ্ন। বাবর আজম আর মোহাম্মদ রিজওয়ানকে বাদ দেওয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল, তাদের ধীরগতির ব্যাটিং ও স্পিনে দুর্বলতার কারণে। তবে এতে মিডল–অর্ডার দাঁড়িয়েছে অনভিজ্ঞদের কাঁধে। অধিনায়ক সালমান আলির স্ট্রাইক রেট ১২৪.৫৩, যা বোঝাচ্ছে তাদের ইনিংস শুরুর রক্ষণশীল প্রবণতা। হুসেইন তালাত ও খুশদিল শাহও গড়পড়তা স্ট্রাইক রেট আর গড় দেখাতে পারছেন না।
তবু আশার আলো আছে। সাইম আইয়ুব ধারাবাহিক না হলেও ২০২৪ বিশ্বকাপের পর থেকে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সাহিবজাদা ফারহান ২০২৫ সালে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন, মাত্র ১০ ম্যাচে চারটি সেঞ্চুরি আর তিনটি ম্যাচ–সেরা পুরস্কার জিতেছেন। হাসান নাওয়াজ নতুন ভরসা হয়ে উঠেছেন মিডল–অর্ডারে। ১৪ ম্যাচে পাঁচটি ভিন্ন পজিশনে ব্যাট করে তার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৭৫.৬৪, যা প্রমাণ করে ছক্কা হাঁকানোর ক্ষমতা ও মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা।
স্পিন আক্রমণেই ভরসা করতে চাইবে পাকিস্তান। রহস্য–স্পিনার আবরার আহমেদ ও সুফিয়ান মুকিমের সঙ্গে আছেন অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নাওয়াজ। যদিও ভারতের বিপক্ষে নাওয়াজের রেকর্ড অনুপ্রেরণাদায়ক নয়। তারপরও এই তিনজন গত বিশ্বকাপের পর থেকে ২৬ ম্যাচে নিয়েছেন ৫৩ উইকেট।
সব মিলিয়ে ভারত যখন চ্যাম্পিয়ন দলকে নতুনভাবে শাণিত করছে, পাকিস্তান তখনো খুঁজছে নিজেদের ছন্দ। আর ক্রিকেট ছাড়িয়ে এই লড়াই দুই দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধানের প্রতিফলন হয়ে উঠছে।
অদ্ভুত হলেও সত্যি, এশিয়া কাপের ইতিহাসে ভারত–পাকিস্তান কখনো ফাইনালে মুখোমুখি হয়নি। অথচ সূচি বারবার সাজানো হয়েছে সে সম্ভাবনা তৈরির লক্ষ্যে। এবারের নতুন রূপে কি তবে ঘটতে যাচ্ছে সেই কাঙ্ক্ষিত ফাইনাল?
যদি হয়, তবে তা শুধু দর্শকদেরই নয়, আয়োজকদেরও বহুদিনের স্বপ্নপূরণ হবে। ক্রিকেট নিয়ে যত সমঝোতা, যত কূটনৈতিক হিসাব–নিকাশ, সবকিছু ছাপিয়ে ভারত–পাকিস্তান ফাইনাল নিঃসন্দেহে হবে ক্রীড়াজগতের অন্যতম সেরা আকর্ষণ।
Comments