মেসি থেকে ফ্লিক, বার্সেলোনার দুঃস্বপ্নের নাম গিল মানজানো

লা লিগার সবচেয়ে প্রতীক্ষিত লড়াই এল ক্লাসিকোর আগমুহূর্তে বড় ধাক্কা খেল বার্সেলোনা। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ডাগআউটে থাকতে পারবেন না কোচ হান্সি ফ্লিক। জিরোনার বিপক্ষে ম্যাচে রেফারি হেসুস গিল মানজানো তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে পাঠান, যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক ম্যাচ নিষিদ্ধ হচ্ছেন এই জার্মান কোচ।
ঘটনাটা ঘটে ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে। গিল মানজানোর ম্যাচ রিপোর্ট অনুযায়ী, '৯০তম মিনিটে কোচ হান্সি ফ্লিক আমার এক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে হাততালি দেন, এজন্য তাকে (হলুদ কার্ড দেখিয়ে) সতর্ক করা হয়। একই মিনিটে, আগেই সতর্ক থাকার পর তিনি আবারও আপত্তিসূচক ইঙ্গিত করেন, তাই দ্বিতীয়বার সতর্ক করা হয়।' অর্থাৎ, টানা দুইবার অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের কারণে ফ্লিককে মাঠ ছাড়তে হয়।
এক্সত্রেমাদুরার এই রেফারির সঙ্গে বার্সেলোনার সম্পর্ক বরাবরই জটিল। গিল মানজানো এখন পর্যন্ত বার্সেলোনার মোট ৪৪টি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন, আর এই সময় তিনি দেখিয়েছেন ১২টি লাল কার্ড। যা তার ক্যারিয়ারে কোনো একক ক্লাবের বিপক্ষে সর্বোচ্চ।
পরিসংখ্যান আরও বলছে, বেতিস তার দ্বিতীয় সর্বাধিক শাস্তিপ্রাপ্ত দল, যারা ৩৬ ম্যাচে পেয়েছে ৭টি লাল কার্ড। অর্থাৎ, বার্সেলোনা গিল মানজানোর 'সবচেয়ে কঠোর ব্যবহারের শিকার' ক্লাব হিসেবে রয়ে গেছে।
এই রেফারির লাল কার্ডের তালিকায় বার্সার কিংবদন্তিদের নামই যেন সারি সারি। লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ, নেইমার, রবার্ট লেভানদভস্কি -সবাই কোনো না কোনো সময় তার সিদ্ধান্তে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। দানি আলভেস ও ক্লেমেন্ট লংলে তো দু'বার করে লাল কার্ড দেখেছেন তার কাছ থেকে। তাছাড়া সের্জিও রবার্তো, জেরার্ড পিকে এবং এমনকি গোলরক্ষক ভয়চেক শেজনিও মানজানোর রায় থেকে রেহাই পাননি।
চলুন দেখে নেওয়া যাক, গিল মানজানোর হাতে কোন কোন বার্সা তারকা লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
*দানি আলভেস (২ বার)
গিল মানজানোর প্রথম শিকার ছিলেন দানি আলভেস।
২০১৪–১৫ মৌসুমে রায়ো ভায়েকানোর বিপক্ষে ৬–১ গোলের জয়ে তিনি প্রথমবার লাল কার্ড দেখেন।
পরে বার্সেলোনায় দ্বিতীয় দফায় ফিরে আসার পরও ভাগ্য বদলায়নি। ২০২১–২২ মৌসুমে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে লা লিগার ম্যাচে সরাসরি লাল কার্ড দেখিয়ে আবারও তাঁকে মাঠ ছাড়ান মানজানো।
*ক্লেমো লংলে (২ বার)
ফরাসি ডিফেন্ডার লংলেও মানজানোর রোষের শিকার দু'বার।
২০১৮–১৯ মৌসুমে গিরোনার বিপক্ষে ২–২ গোলের ড্র ম্যাচে সরাসরি লাল কার্ড দেখেন তিনি।
পরেরবার ২–০ গোলে গেতাফেকে হারানোর ম্যাচে দুটি হলুদ কার্ড মিলিয়ে লাল কার্ড দেখেন লংলে।
*সের্জিও রবার্তো
২০১৬–১৭ মৌসুমের কোপা দেল রে সেমিফাইনালে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় সের্জিও রবার্তোকে।
এর ফলে ফাইনালে আলাভেসের বিপক্ষে খেলতে পারেননি তিনি।
*লুইস সুয়ারেজ
সেই একই ম্যাচেই আরেক নাটকীয় মুহূর্তের জন্ম দেন লুইস সুয়ারেজ।
আতলেতিকোর কোকের সঙ্গে হালকা ধাক্কাধাক্কির জেরে গিল মানজানো তাঁকেও দুটি হলুদ কার্ড দেখিয়ে মাঠ ছাড়ান।
*নেইমার জুনিয়র
নেইমারও গিল মানজানোর শিকার।
মালাগার বিপক্ষে ম্যাচে প্রথমে ফ্রি-কিক ব্লক করতে গিয়ে, এরপর ট্যাকল করার অপরাধে তিনি দুটি হলুদ কার্ড দেখেন।
ম্যাচের পর রেফারির সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে আরও তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পান ব্রাজিলিয়ান তারকা।
*লিওনেল মেসি
২০২১ সালের স্প্যানিশ সুপার কাপ ফাইনাল—সেই ম্যাচে ইতিহাস গড়েন গিল মানজানো।
বার্সার কিংবদন্তি মেসিকে সরাসরি লাল কার্ড দেখান তিনি, বিলালিব্রের সঙ্গে এক সংঘর্ষে হাত ছাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়।
এর মাধ্যমে মেসি, নেইমার ও সুয়ারেজ- 'এমএসএন' ত্রয়ীই মানজানোর শাস্তিপ্রাপ্ত হন।
*জেরার্দ পিকে
২০২২–২৩ মৌসুমে ওসাসুনার বিপক্ষে ম্যাচে হাফটাইমে রেফারির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে তর্কে জড়ান পিকে।
গিল মানজানো তাকে তখনই মাঠে না নামিয়েই লাল কার্ড দেখান।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেটিই ছিল পিকের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।
*রবার্ট লেভানদভস্কি
ওই একই ম্যাচে পিকের সঙ্গে লাল কার্ড দেখেন লেভানদভস্কিও।
দুটি বিতর্কিত হলুদ কার্ডের পর মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে, পরে নাক ছোঁয়ার এক অঙ্গভঙ্গির কারণে আরও তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হন এই পোলিশ স্ট্রাইকার।
*বয়চেক শেজনি
স্প্যানিশ সুপার কাপের গত মৌসুমে এমবাপেকে ফাউল করে শেষ ডিফেন্ডার হিসেবে লাল কার্ড দেখেন পোলিশ গোলরক্ষক শেজনি।
গিল মানজানোর সিদ্ধান্তে তিনিও যোগ হন বার্সার 'লাল কার্ড তালিকায়।'
*হান্সি ফ্লিক
সবশেষে, গিল মানজানোর নতুন শিকার হান্সি ফ্লিক।
জিরোনার বিপক্ষে ম্যাচের ইনজুরি টাইমে রেফারির সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে হাততালি দেন, পরে আপত্তিসূচক ইঙ্গিতও করেন।
ফলাফল, দুটি টানা হলুদ কার্ড, এবং ক্লাসিকো থেকে নিষিদ্ধ।
হান্সি ফ্লিকের এই নিষেধাজ্ঞা বার্সেলোনার জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ। মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোর একটি, যেখানে অভিজ্ঞ জার্মান কোচের কৌশল ও উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত জরুরি। তার অনুপস্থিতিতে সহকারী কোচকে দায়িত্ব নিতে হবে ক্লাসিকোর মতো বিশাল চাপের ম্যাচে।
কাতালান গণমাধ্যমগুলো বলছে, বার্সেলোনার ভেতরে এখন ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে গিল মানজানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে। অনেকেই অভিযোগ তুলছেন, এই রেফারির সঙ্গে ক্লাবের একটি 'অলিখিত টানাপোড়েন' বহুদিন ধরেই চলছে।
সবশেষে, জিরোনার বিপক্ষে এই ঘটনার পর আবারও আলোচনায় উঠে এলো সেই পুরনো প্রশ্ন, 'গিল মানজানোর সিদ্ধান্তগুলো কি বার্সেলোনার বিপক্ষে পক্ষপাতমূলক?' যে যাই বলুক, এতটুকু নিশ্চিত, এল ক্লাসিকোতে হান্সি ফ্লিকের অনুপস্থিতি বার্সেলোনার জন্য বিশাল আঘাত।
Comments