জাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষক মৌমিতাকে অশ্রুসজল বিদায়

শুক্রবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে এলো একটি সাদা অ্যাম্বুলেন্স। গাড়ির চারপাশ ঘিরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের ভিড়।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই যিনি জাকসু নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করছিলেন, অ্যাম্বুলেন্সে চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতার নিথর দেহ।
মৌমিতাকে ঘিরে কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এক সময় এই ক্যাম্পাসেই পড়ালেখা করেছেন জান্নাতুল, তারপর গড়ে তুলেছিলেন তার একাডেমিক জীবন। সেই ক্যাম্পাসেই তার জীবনের ইতি হলো।
মোমিতা ছিলেন তার বিভাগের প্রথম স্নাতক। এরপর তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জাকসু নির্বাচনে ভোট গণনায় অংশ নিতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন মৌমিতা। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি প্রীতিলতা হলে পোলিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন।
দুপুর ২টায় কেন্দ্রীয় মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শতাধিক মানুষ জানাজায় অংশ নেন।

মৌমিতার ছাত্রী জান্নাতুল বলেন, 'ম্যাডাম আমাদের কাছে শুধু শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের বড় বোনের মতো। প্রথম দিন থেকেই তিনি যেমন আমাদের শিক্ষক ছিলেন, আবার বড় বোনও। যেভাবে তিনি আমাদের পড়াতেন, তা কেউ পারবে না। ম্যাডামের সঙ্গে আমাদের সুন্দর স্মৃতিগুলো সব সময় মনে থাকবে।'
বলতে বলতে গলা ধরে আসে তার। নিজেকে সামলে জান্নাতুল আরও বলেন, 'রোববার ম্যাডামের সঙ্গে আমাদের ল্যান্ডস্কেচ ক্লাস করার কথা ছিল…।'

চারুকলা বিভাগের ৪২তম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন মোমিতা। সে সময় ক্যাম্পাসে তিনি পরিশ্রমী শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, মাত্র একদিন আগেও মৌমিতাকে তারা সুস্থ ও প্রাণবন্ত দেখেছেন। 'গত বুধবার চেয়ারম্যানের রুমে ম্যাডামের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি একেবারে সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। এমনকি আমাদের কোর্সও নিয়েছিলেন,' বলেন ৫৩তম ব্যাচের আসিফ রহমান।
জান্নাতুল বলেন, 'আজ সকালে খবরটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তিনি অসুস্থ ছিলেন না, পুরোপুরি ফিট ছিলেন। নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকার পরও তিনি আমাদের পরবর্তী ক্লাসের সময়সূচি জানালেন। কী বিষয়ে পড়াবেন তাও জানিয়ে দিয়েছিলেন।'
৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ঐশী সরকার বলেন, 'আমাদের প্রথম ক্লাস ছিল ম্যাডামের সঙ্গে। ব্যক্তিগত কিংবা একাডেমিক—যেকোনো প্রয়োজনে গেলে তিনি কখনো আমাদের ফিরিয়ে দিতেন না। কষ্টে সান্ত্বনাও দিতেন, দুশ্চিন্তায় পরামর্শ দিতেন। তিনি নাই এটা মেনে নেওয়া সম্ভব না।'

একটু দূরে দাঁড়িয়ে আরেক শিক্ষার্থী ভেজাস্বরে বলেন, 'আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে এখনো তার মেসেজ আছে...নতুন ল্যান্ডস্কেপ ক্লাস শুরু করার কথা বলেছেন...। যেসব শিক্ষার্থীরা আগের কোর্স মিস করেছে, তাদেরও আসার জন্য মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।'
শোকাহত তার সহকর্মীরাও। উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, 'মোমিতা ছিল আমার মেয়ের মতো। নানা বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতো। মনে হচ্ছে যেন নিজের মেয়েকেই হারালাম।'
জানাজা শেষে উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, 'তিনি ছিলেন খুবই তরুণ সহকর্মী। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতেন। তার হঠাৎ চলে যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা যত কিছুই করি না কেন, শেষ পর্যন্ত সবাইকেই চলে যেতে হবে।'
জানাজার আগে তার মরদেহ পুরাতন কলা ভবনের সামনে রাখা হয়। সেখানে সহকর্মী ও বন্ধুরা তাকে শেষবারের শ্রদ্ধা জানান।
চারুকলা বিভাগে মৌমিতার সহকর্মী সহকারী অধ্যাপক অসীম চন্দ্র রায় বলেন, 'মৌমিতা ছিলেন শান্ত, বিনয়ী ও কোমল স্বভাবের। তার হঠাৎ মৃত্যু মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। সবার মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা এক রকম থাকে না। তিনি হয়তো অতিরিক্ত চাপ নিতে পারেননি। নির্বাচন ঘিরে যে অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছিল, তারই করুণ ফলাফল এই মৃত্যু।'
বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও প্রীতিলতা হলের রিটার্নিং অফিসার ড. মোহাম্মদ শামীম রেজা বলেন, 'মৌমিতা আমার সরাসরি ছাত্রী ছিল—সব সময় দায়িত্বশীল ও নিবেদিতপ্রাণ। মোমিতা একদিন বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ তার ওপর এই দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতে মানসিক চাপ তৈরি হয়। সবার সহ্যশক্তি এক না।'
Comments