চার্লি কার্ক হত্যার পেছনে মোসাদের হাত?

হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ইউটাহ অঙ্গরাজ্যে। গত ১০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু, এর তুলনা টানা হচ্ছে ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির এক ঘটনার। প্রায় ৯২ বছর আগের সেই ঘটনাটি ঘটেছিল জার্মানিতে। সেদিন আগুন দেওয়া হয়েছিল জার্মানির পার্লামেন্ট ভবনে। সেই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছিল কমিউনিস্টদের।
গত বুধবার ইউটাহ ভ্যালি ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় ডানপন্থি রাজনীতিক, বিশ্লেষক ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ঘনিষ্ঠ মিত্র ৩১ বছর বয়সী চার্লি কার্ককে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে হাসিমাখা মুখে বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে ভক্তদের সঙ্গে কথা বলছিলেন চার্লি। মাইক্রোফোনে দিচ্ছিলেন একেক প্রশ্নের জবাব। সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়—একটি গুলি প্রতি সেকেন্ডে ৮০০ মিটার গতিতে ১৫৩ মিটার দূরে থাকা চার্লির গলা/ঘাড়ে বিদ্ধ হয়। সেসময় মঞ্চের এক পাশে বসে মাইক্রোফোনে গ্যাং ভায়োলেন্স নিয়ে নিজের মত দিচ্ছিলেন তিনি।
দিনে দুপুরে ভরা মজলিসে এমন হত্যাকাণ্ড দেখে বিস্মিত সবাই। হত্যাকাণ্ডের পরপরই ক্ষুব্ধ ট্রাম্প দোষ চাপালেন 'উগ্র বামপন্থি'দের ওপর। শুধু তাই নয়, আরও বিরক্তি নিয়ে বললেন, 'এই দেশে উগ্র বামপন্থি আছে। নিঃসন্দেহে তারা উন্মাদ। আমরা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। আমি শুধু আমার দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন।'
ট্রাম্পের সেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে অন্য রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও।
মোসাদ চার্লি কার্ককে হত্যা করেছে?
মার্কিন সমাজে চার্লি এতটাই জনপ্রিয় যে ট্রাম্প তার এই ভক্তকে প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তার মৃত্যু নিয়ে একটি পোস্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ৭০ লাখ ভিউ পেরিয়ে যায়।
এমন এক জনপ্রিয় তরুণ নেতার মৃত্যুকে ঘিরে ছড়াচ্ছে 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব'। চার্লির রক্ষণশীল তথা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতবাদের সমর্থকদের অনেকে মনে করেন- এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে 'মোসাদের' হাত আছে। তাদের বিশ্বাস, ইহুদি ও ইসরায়েল এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।
গত ১১ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সামাজিক মাধ্যমে দুই লাখের বেশি ফলোয়ার থাকা এক পডকাস্ট হোস্ট রায়ান ম্যাট্টা লিখেছেন, 'এমন পরিস্থিতিতে কেউ কি ভাবছে না চার্লি কার্ককে মোসাদ (ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা) হত্যা করেছে?'
হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে এই ধরনের অভিযোগ চাউর হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে অতীতে চার্লির বিরুদ্ধে যে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ উঠেছিল, তাও সামনে চলে এসেছে। মার্কিন বিনিয়োগকারী জেফরি এপস্টাইনের সঙ্গে মোসাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে চার্লির মন্তব্য ও চার্লির মৃত্যুতে ইসরায়েলি রাজনীতিকদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর বিষয়টিও উঠে এসেছে।

গত ১৩ আগস্ট টেক্সাসের এক অধিবাসী হ্যারিসন স্মিথ এক পোস্টে লিখেছিলেন, 'আমি কারও নাম বলতে চাচ্ছি না। তবে চার্লি কার্কের ঘনিষ্ঠ একজনকে বলতে শুনেছি যে, চার্লি মনে করতেন তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেলে তারা তাকে হত্যা করতে পারে।' গত বুধবার পর্যন্ত তিনি এমনটাই বিশ্বাস করতেন।
টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কারও কারও মতে ইহুদি ও ইসরায়েল নিয়ে চার্লির সাম্প্রতিক বক্তব্যের কারণে তিনি লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকতে পারেন।
এতে আরও বলা হয়—উগ্র ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত ম্যাট ফর্নি মনে করেন, চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ড হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের 'রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ড'। অর্থাৎ, জার্মানির পার্লামেন্ট ভবনের আগুন। তিনি লিখেছেন, 'এখন বামপন্থিদের ওপর পুরোপুরি কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সময়। প্রতিটি ডেমোক্রেটিক রাজনীতিককে অবশ্যই গ্রেপ্তার করতে হবে। এই দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রতিটি উদারপন্থি কণ্ঠস্বরকে অবশ্যই নিস্তব্ধ করে দিতে হবে।'
তবে ট্রাম্প তার সমর্থকদের অহিংস নীতি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।
'বদ্ধ উন্মাদ'
চার্লি কার্ক 'টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ'র প্রতিষ্ঠাতা। এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্কুল-কলেজে রক্ষণশীল রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার করে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীর সংখ্যা কমাতে চাইতেন। আরও চাইতেন শ্বেতাঙ্গদের প্রাধান্য অটুট থাকুক।
তিনি খ্রিষ্টান হয়েও ছিলেন ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক। তারপরও তার হত্যাকাণ্ডের পেছনে 'মোসাদ তত্ত্ব' কেন? এমন প্রশ্নের জবাব হয়তো এখনই সরাসরি দেওয়া সম্ভব নয়, তবে সামাজিক মাধ্যমে প্রভাবশালী ইসরায়েলপন্থিরা বলছেন ভিন্ন কথা।
তাদের একজন ইয়াল ইয়াকোবির অভিযোগ, 'এক সময় যারা চার্লি কার্ককে ইহুদিদের ক্রীড়নক বলে ডাকতেন, এখন তারাই বলছেন মোসাদ তাকে হত্যা করেছে। তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা এই বিয়োগান্তক ঘটনাকে নিজেদের পৈশাচিক স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে।'
অপর ইসরায়েলপন্থি ইলন লেভি লিখেছেন, 'চার্লি কার্কের মরদেহ এখনো শীতল হয়নি। কিন্তু, ইহুদিবিদ্বেষী ষড়যন্ত্রকারীরা ইতোমধ্যে মোসাদকে দায়ী করে ফেলেছে।'
গত ১১ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সাংবাদিক ওয়েন জোন্স এক এক্স পোস্টে লিখেছেন, 'নাৎসিরা সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ব্যবহার করেছে। তারা প্রথমে বামপন্থিদের নিশ্চিহ্ন করে। তারপর ইহুদিদের। আমরা জানি না, চার্লি কার্ককে কারা হত্যা করেছে। কিন্তু, ট্রাম্পভক্ত উগ্র ডানপন্থিদের বিশ্বাস, তারা একটা যুৎসই সুযোগ পেয়েছে।'
এসব ঘটনা এত দূর গড়িয়েছে যে, এ নিয়ে মুখ খুলতে হয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে। তিনি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে 'বদ্ধ উন্মাদ' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি একে 'উদ্ভট গুজব' মনে করেন।
ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছেন যে, চার্লি কার্কের হত্যাকারী সন্দেহে ২৩ বছর বয়সী টাইলার রবিনসনকে আটক করা হয়েছে। আজ শনিবার এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—'মুসলমান বা অভিবাসী বা কৃষ্ণাঙ্গ নন: চার্লি কার্কের সন্দেহভাজন হত্যাকারীর পরিচয় প্রকাশের পর বিতর্ক বেড়েছে'।
শুধু চার্লি কার্কের হত্যাকারীকে নিয়ে নয়, তার হত্যাকাণ্ডও যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে তা বলাই বাহুল্য। তবে তার হত্যাকাণ্ডে মোসাদের হাত নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, এর প্রকৃত জবাব কবে পাওয়া যাবে তা সময়ই বলতে পারে।
Comments