যেখানে হেরে যায় আসলে ক্রিকেট

বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের এক পর্যায়ে এমন একটা স্লোগানের আওয়াজ এলো যেটাতে কান খাড়া হতে বাধ্য। যে স্লোগানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার কোন সম্পর্ক নেই, নেই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের কোন চিহ্ন। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের জয়গানের স্লোগান ভারতের বিপক্ষে দেওয়ার অন্য মানে দাঁড়িয়ে যায়। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে ভারতীয় এক দল সমর্থকদেরও ঠিক বিপরীত ধর্মীয় স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছিলো।
উপমহাদেশীয় দলগুলোর ক্রিকেট খেলা হলে প্রায়ই রাজনীতি ও ধর্মের মিশ্রণে এক ধরণের পরিবেশ তৈরি হয়, যা এই অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িক মানুষের জন্য বেশ অস্বস্তিকর। কিন্তু দুঃখজনক হলো ক্রিকেট বাণিজ্য সেই রগরগে উপাদানকেই রসদ যোগায়।
ক্রিকেটে এশিয়া কাপের সূচনা হয়েছিলো এই অঞ্চলের দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্মিলনের চিন্তা থেকে। গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক আসরের সূচিকে বিবেচনায় নিয়ে আয়োজিত হয় এশিয়া কাপ। ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে আয়োজন হয় ওয়ানডে সংস্করণের এশিয়া কাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে হয় টি-টোয়েন্টির। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসির) বাহ্যিক উদ্দেশ্য এশিয়ার দলগুলো যেন বিশ্বকাপে ভালো করে, প্রস্তুতি যেন সবার ভালো হয়। এটা এখন একটা কৌতূকের মতন ব্যাপার। এশিয়া কাপে সৌহার্দ্য তো বাড়েই না বরং আবাদ হয় বিদ্বেষের। এমন সব উপকরণ জড়ো হয় যেখানে নিখাদ ক্রিকেট প্রেমীর বিনোদন থেকে মাথায় চাপ নেওয়ার শঙ্কা থাকে বেশি। কেবল বাণিজ্যিক কারণেই সূচি এমনভাবে করা হয় যাতে ভারত-পাকিস্তানের একাধিক ম্যাচ থাকে।
এবার এশিয়া কাপে সেই উপকরণ যেন একটু বেশি। পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতীয় ক্রিকেটারদের খেলা শেষে সৌজন্যমূলক হাত না মেলানো দিয়ে শুরু। শাহেবজাদা ফারহানের ফিফটি করে আপত্তিকর রাইফেল তাক করা উদযাপন পর্যন্ত চলমান। পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার জেরে দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়েছে কয়েকমাস আগে। কিন্তু এসবের সঙ্গে তো শাহীদ আফ্রিদিদের সম্পর্ক থাকতে পারে না। মজার কথা হলো প্রায় একই সময়ে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ভারত-পাকিস্তানের ফুটবল খেলায় দুই দলের খেলোয়াড়রা সৌজন্যতা বিনিময় করেছেন। তাহলে ক্রিকেট ব্যতিক্রম কেন? কারণ ক্রিকেটে আছে এই অঞ্চলের সবচেয়ে কড়া নজর, আছে বাণিজ্যিক রসদ। যেটা উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা প্রভাবিত।
এবং আয়োজক এসিসিকে ন খেলার স্পিরিটের বাইরের চরম রাজনৈতিক অনুষজ্ঞ নিয়ে নির্বিকার দেখা যাচ্ছে। হাত না মেলানো, প্রেজেন্টেশন বর্জন, সংবাদ সম্মেলন বর্জন নিয়ে তারা নির্লিপ্ত। শত্রু বধ করেছেন, ফিফটির পর রাইফেল তাক করা এমন আপত্তিকর ভঙ্গির কারণে কোন শাস্তি পেতে হয় না ফারহানকে।
টুর্নামেন্ট কাভার করতে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংবাদিক এসেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। অনেকেই একে অন্যের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। এর আগে বিস্তর আড্ডায় মাততে দেখা গেলেও এবার কেমন জানি একটু সতর্ক ভঙ্গি সবার। বন্ধুত্ব দেখাতে গিয়ে যদি আবার দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়! রাজনীতি তো এমন বিষাক্ত পরিবেশেই বন্দি করে রেখেছে গোটা অঞ্চলকে।
এর আগে বহুজাতিক আসরে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের সাবেক ক্রিকেটারকে ঘিরে তাদের গণমাধ্যম-কর্মীদের তুমুল আড্ডায় মেতে থাকতে দেখা গেছে। ভারতের কিংবদন্তি তারকা সুনিল গাভাস্কার এবার বার কয়েক প্রেস বক্সে এলেও একটা যেন পর্দা নেমে গেছে।
১৯৪৭ সালের আগে একই দেশের অংশীদাররা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হলেও বন্দি হয়ে আছে যেন উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায়। দেশভাগের ধাক্কায় চন্ডিগড় থেকে লাহোরে পাড়ি জমানো ব্যক্তিকে জীবন সায়াহ্নে এসে হয়ত নিজের জন্মভিটা, শৈশবের স্মৃতিকে ঘেন্না করতে হচ্ছে। একই কথা সত্য বর্ধমান থেকে ঢাকায় চলে আসা ব্যক্তির, কিংবা খুলনা থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া অন্য কারো। ভাষা, সংস্কৃতির নব্বই ভাগ মিল থাকার পরও রাজনীতি এমন দেয়াল তুলে রেখেছে যেটা প্রায় অনতিক্রম্য।
দক্ষিণ ভারতের ট্যাক্সি চালক শ্রীনিবাস থোট্টা যেমন বলছিলেন, ক্রিকেটের প্রতি তার মনই উঠে গেছে, 'এখন একদম পছন্দ করি না ক্রিকেট খেলা। এরচেয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ অনেক ভালো।'
পাকিস্তানের আদিল শেহজাদ যেমন বিরাট কোহলির ভক্ত। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই নাজুক তিনি এখন বন্ধু মহলেও এটা বলার সাহস পান না। ওয়াসিম আকরামের মায়াবী স্যুইং কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্রেট ড্রাইভ ভালো লাগে না এমন ক্রিকেটপ্রেমী পাওয়া মুশকিল। কিন্তু রাজনীতি আপনাকে বলবে, 'ভালো লাগলেও বলতে নেই'।
উপমহাদেশীয় দলগুলোর মধ্যে যেসব দ্বৈরথের গল্প তার মধ্যে ক্রিকেট থেকে অনেক বেশি আছে রাজনীতি। সেটা যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় বিপুল টাকার অঙ্কে এসিসির থলে ভরলেও হেরে যায় আসলে ক্রিকেট।
Comments